মায়ার দেশ মায়ং


রবিবারের পড়ন্ত দুপুরে আমরা দুই ভাই অত্যুৎসাহে সদ্যকেনা গল্পের বই পড়ছি, এমন সময়ে ঘরে সোনাদার প্রবেশ।আমাদের মাসতুতো দাদা সোনাদা প্রায় প্রতি রবিবারেই আমাদের বাড়ী চলে আসে আর দেদার গল্পশেষে রাতের খাওয়া সেরে হস্টেলে ফেরে।

ঘরে ঢুকেই সোনাদা বলে,

– তা কোন কোন বই পড়া হচ্ছে কিট্টু বিট্টু?

আমাদের দু’জনের হাতেই হ্যারি পটার সিরিজের দুটো বই দেখে সোনাদা বলে,

– ওই বইয়ের হ্যারির মত তোদের ইচ্ছে করে না হগওয়ার্টসে যেতে?আমি গিয়েছিলাম জানিস,আমাদের দেশের হগওয়ার্টসে!একটা গোটা গ্রামই যাদুবিদ্যালয় যেখানে প্রতি পরিবারেই বেড়ে ওঠে আসল হ্যারি পটার।মায়ার দেশ মায়ং!

অসমের গুয়াহাটি শহর থেকে প্রায় ৪০ কিমি দূরত্বে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী মরিগাঁও জেলায় অবস্থিত মায়ং গ্রাম।মায়াং-এ পৌঁছাতে গেলে পেরোতে হয় একটা সেতু।সেই সেতুই যেন আমাদের লৌকিক পৃথিবীর সাথে অলৌকিক মায়ং -এর একমাত্র যোগস্থাপক।রহস্যময় মায়ং গ্রামে প্রবেশের সাথে সাথে ভিড় করে গল্পেরা।

মায়ং শব্দটির উৎস সংস্কৃত শব্দ “মায়া” – যার অর্থ ভ্রম বা যাদু।আবার “মা” অর্থাৎ শক্তিদেবীর অংগ এই অঞ্চলে পতিত হয়েছে বলে এমন নামকরণ হয়েছে বলে দাবী করেন অনেকেই।কিছু মানুষের মতানুসারে,মাইরাং জাতি এখানে বসবাস শুরু করার পর থেকে এই স্থানটির নাম মায়হং বা মায়াং হয়।আবার অনেকের মতে উত্তর-পূরব ভারতের এই পাহাড়ী অঞ্চল “মিয়ং” বা হাতির বসতিস্থল হওয়ায় এমন নামকরণের কারণ।

মহাভারতে উল্লিখিত প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা মায়াবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন।কাছারি রাজ্যের অধিপতি ঘটৎকচ তার ঐদ্রজালিক ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে।’মায়া’ – এই ক্ষুদ্র শব্দটিই প্রযুক্ত হয়েছে এই ভূমির ক্ষেত্রে।

এখানকার মাটির প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে কালোযাদু।যুগযুগ ধরে এই অঞ্চল ছিল অপরাজেয়।কথিত আছে এখানকার তান্ত্রিকরাই নাকি একসময়ে রুখে দিয়েছিলেন ইসলাম আক্রমণ।এখানকার ভূমিপুত্ররা মায়া বা কালোযাদুবিদ্যার চর্চা অব্যাহত রেখেছেন আজও।আজও নাকি এই গ্রামটি একইভাবে লিপ্ত রয়েছে তন্ত্রের সবচেয়ে ছায়াচ্ছন্ন শাখা ডামরতন্ত্র চর্চায়।উড্ডীয়ান তন্ত্রের কিংবদন্তীও শোনা যায়, যার প্রয়োগে আকাশে ওড়াও সম্ভব।মধ্যযুগ এবং তারপরও শক্তিসাধনায় এখানে নরবলির প্রচলন ছিল।সম্প্রতি খননকার্যের ফলে তরবারি ও অন্যান্য ধারালো অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা নরবলির ঈংগিতবাহী।

সারাদিন ঘুরলাম গ্রামের পথেঘাটে।ব্রহ্মপুত্রকে ছুঁয়ে থাকা পাথুরে তীরের গায়ে রয়েছে অসংখ্য দেবদেবীর মূর্তি। তারমধ্যে কয়েকটি বিশালাকায় মূর্তি সিঁদুরচর্চিত। প্রায় প্রত্যেক বাড়ীতেই রয়েছে অতি দুষ্প্রাপ তান্ত্রিক পুঁথি, যেগুলো কোনো সংগ্রহশালায় দিতে তারা নারাজ।কিন্তু তাও গ্রামের নিজস্ব সংগ্রহশালায় আছে বেশ কিছু পুঁথি।২০০২ সালে উদ্বোধিত মায়ং কেন্দ্রীয় যাদুঘর ও এম্পোরিয়াম কালোযাদু ও আয়ুর্বেদ পুঁথিসহ বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি ও শিল্পকর্মাদি দ্বারা সমৃদ্ধ।

মায়ং-এর খুব কাছেই রয়েছে পবিতরা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য,যেখানে বিচরণ করে একশৃংগ গণ্ডার।

দিনেরবেলাই মায়াং এর বাতাস ফিসফিস করে বলে যায় কত গল্প,মায়ং-এর মাটিতে পাক দিয়ে ওঠে রহস্য।তাই সেখানে রাত্রিবাসের সাহস হল না।সন্ধ্যের অন্ধকার নামার আগেই রহস্যময় মায়াং ছেড়ে রওনা দিয়েছিলাম গুয়াহাটির দিকে।

মায়াং যেতে হলে গুয়াহাটিগামী যেকোনো ট্রেনে বা প্লেনে গুয়াহাটি পৌঁছে গাড়ি করে একদিনেই ঘুরে আসা যায় মায়ং।অসমের রাজধানী গুয়াহাটিতে ছোট-বড় বিভিন্নমানের হোটেল আছে।গুয়াহাটিকে কেন্দ্র করে ঘুরে আসা যায় কাছেদূরের আরও অনেক দ্রষ্টব্য স্থান।

– কীরে, যাবি নাকি মায়ার দেশ মায়াং?

এইকথা বলেই সোনাদা শূণ্যে হাত ঘুরিয়ে আমাদের সামনে বাড়িয়ে দিল দুটো চকোলেট।

-চুমকি ভট্টাচার্য



শেয়ার করুন
Brush

আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ