আপনার ভাষা নির্বাচন করুন
সেই যে বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন না, ” প্রকৃতির মধ্যে এলে মন পাপড়ি মেলতে থাকে। যে কথা, যে কাজ অন্য জায়গাতে করা যেত না, যা করার কথা ভাবাও যেত না, তাই করা যায়, ভাবা যায়। উই আর অলওয়েজ ইন আওয়ার এলিমেন্টস হোয়েনেভার উই কাম টু নেচার। ” বড় সত্যি কথা। ঠিক যে কয়েকটা এলিমেন্টস দিয়ে আমরা তৈরী, অনুভবের সেই সবকটা স্তর বড় ঢেকে থাকে শহরের ধুলো ধোয়াঁর আস্তরণে, সেগুলো রক্তমাংসের আমির এতো ভিতরে চাপা পরে থাকে, সে সেগুলোর অস্তিত্বই টের পাইনা বড়। কিন্তু এই খোলা হাওয়া, এই উম্মুক্ত আকাশ, এই উদার আলোর বনপাহাড়ের পদাবলীতে, পা রাখা মাত্রই শরীরে, মনের, রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটা চাপা আনন্দ শুরু হয়ে যায়, একটা দুদ্দাড় খেলা গোপনে গোপনে ইচ্ছেমেঘ হয়ে বেরিয়ে আসে। আমরা ফিরে আসি আমাদের কাছে, আমাদের অনুভবের কাছে।
এই যে পাকদন্ডী বেয়ে বেয়ে পাহাড়ে চড়ছি , নিরবচ্ছিন্ন প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে একবার ডানদিক , একবার বাঁদিক ঘেঁষে গাড়ি উঠে যাচ্ছে আকাশের আরো কাছাকাছি আর বুড়ি ছোয়াঁর দূরত্বের মতো ইমাত্তর যে নীলচে সবুজ পাহাড়ের ওইপাশে দেখলাম একটা ছোট সাদা বুদ্ধিস্ট ইমারত ,ওমা চুলের কাঁটার মতো মোড় ঘুরতেই সে দেখি আমার হাতের পাশেই। ওই যে ঝর্ণা দূর থেকে চিকচিক করছিলো ইশকুল ফেরত মেয়েটার মাথার চুলের ফিতের মতন, কাছাকাছি এসে দেখো , কি খোলতাই তার রূপ, কি ঝিলিক তার স্রোতে। যত উঠছি, তাপমাত্রা কমতে কমতে ততই বেশ মোলায়েম একটা আবহাওয়া তৈরী হচ্ছে। সেই যে রবি ঠাকুরের শিলং যাত্রা, কি দারুন লিখেছিলেন, ‘ পাহাড়ে চড়িবার অনতিবিলম্বেই গাড়ির মধ্যে খক খক, খুক খুক নানা প্রকার শব্দে মালুম হইলো পাহাড়ে পৌছাইয়াছি। গলায় গলায় মাফলার উঠিল, কানে কানচাপা টুপি।” ….. ঠিক তাই। কে বলবে জোড়থাং অবধিও কি অসম্ভব গরম পেয়েছি। তবে এ মুহূর্তে আমরা এক্কেবারে পাইনের জঙ্গলের পাতাঝরা পাহাড়ি পাকদন্ডী পেরিয়ে উঠে যাচ্ছি ক্রমশ উঁচুতে, ইচ্ছেখুশির খাসতালুকে। পথে নৈঃশব্দ আর চোখ জুড়োনো প্রকৃতি, সঙ্গী বলতে এই দুজন। গাড়ির সামনের কাঁচ মাঝেমধ্যেই ঢেকে যাচ্ছে সাদা ধোয়াঁর মতো গাঢ় কুয়াশায়। ঠিক যেন ভোর পাঁচটার কাজলধোয়া আকাশ । এই আছে, এই সব সাদা, এক হাত দূরেও কিছুই চোখে পড়ছেনা মোটে, আবার নিমেষেই দ্যাখো, সেসব উধাও। আরেকটা মোড় ঘুরতেই বিরাট বিরাট পাইনের সারির মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মাথা উঁচু করে দেখতে পাচ্ছি ঝিলমিল করে হাসছে আকাশছোঁয়া গাছের মাথায় শেষ বেলার সালমা জরির মতো রাঙা রোদ্দুর।
…..পাহাড়ের একটা অসমাপ্ত ম্যাজিক আছে। এ ম্যাজিক কোনোদিন শেষ হয়না। শেষ হবার নয়! ম্যাজিশিয়ান যেন মঞ্চের উপর টুপি খুলে শেষ অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে অথচ হাততালি পড়ছেনা এখনো, পর্দা টানা হয়নি, আরো কি যেন বাকি, দর্শকেরা তাই আরো একটু রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায় গাঢ়। আমার এই পাকদন্ডী বেয়ে পাহাড় দেখাও ঠিক তেমনি। প্রতি বাঁকেই নতুন ছবি, প্রতি মোড়েই খুশির রুমাল ! হাতঘড়ি বলছে বিকেল পাঁচটা। মাঝেমধ্যেই রাস্তার অসম্ভব খারাপ চড়াই আর উৎরাই। হফ্টখানেক আগেও ল্যানস্লাইড হয়ে শুনলাম কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে এই রাস্তায়। বিরাট বিরাট শক্ত কালচে বাদামি পাথুরে মাটির চাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাস্তায়। আচ্ছা, এইরকম ক্যানভাসের মতো যত্নে আঁকা প্রকৃতির কোলে মৃত্যু হলে তার বীভৎসতা কি একটু হলেও কমে যায় ? কে জানে , খুব সুন্দরের কাছে এলে মানুষের মরতে ইচ্ছে করে শুনেছি ! আমার ও করে! কেমন মনে হয় এখানেই লীন হয়ে, লগ্ন হয়ে শেষ হোক বাকিটুকু। জীবন ও মৃত্যুর একদম পাশাপাশি এই বিপুল আয়োজনের পাশেই কোন অমরাবতী থেকে, কোন উত্তর থেকে পাথর ধরে ধরে একটুকরো তিরতিরে স্রোত পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে সবুজ ছুয়েঁ ছুয়েঁ ঝরে পড়ছে ছোট্ট একটুকরো ঝোরার মতো। হঠাৎ মনে হলো আমার তো ছোটবেলায় কোনোদিন পাহাড় দেখা হয়নি। তখন ইশকুলে পাহাড়ের ছবি আঁকতে দিলে ছবির এক কোনে ঠিক এইরকম সাদা আর নীল মোমরং ঘষে ঘষে ফিতের মতো একটা ঝর্ণা আঁকতাম। মাঝখানে মাঝখানে মাথা উঁচু করা এবড়োখেবড়ো পাথর ! কে জানে, মনের কোন গহন কোনে লুকিয়ে ছিল এ ছবি, হয়তো বা আগের জন্মের দেখা ঠিক এইরকম কোনো ছবি, কোনো মরচে রঙা রোদ্দুরে ঠিক এইরকম কোনো বিকেলে হয়তো পাহাড়ে চড়ার লুকিয়ে থাকা গল্প, সেদিন কথা বলেছিলো ফিসফিসিয়ে !
ছোটবেলায় সঞ্চয়িতা পড়ে শোনাতো মা। ” দিনের আলো নিবে এলো, সূয্যি ডুবে ডুবে ,আকাশ ঘিরে মেঘ জমেছে, চাঁদের লোভে লোভে , মেঘের ওপর মেঘ করেছে, রঙের ওপর রং ….রঙের ওপর রং ? ‘ ঠিক এই জায়গাটায় আমি আটকে যেতাম, মনে মনে ঠিক শুরু হয়ে যেত ষোলো এম এম এর সিনেমা, মেঘের ওপর যখন মেঘ জমে, সেটাকে না হয় সাদা কাগজের উপরে একটু কালো রং ঘষে, তার ওপরে সাদা ঘষে ঘষে ফুটিয়ে তুলতে পারি কিন্তু কেমন করে রঙের ওপর রং ধরাবো? তিনতলার ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম অনিমেষ। শহরের ভাঙাচোরা স্কাইলাইনে তখন হলুদের ওপর সবুজের আভাস, তার ওপর সূর্যাস্তের কমলা আর বেশ খানিকটা ফিকে গোলাপীও। এই এতো আলো, এতো রং আমার এই বাক্সের বারোটা রং দিয়ে কেমন করেই বা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব ? আজ যখন পাহাড়ের আকাশ দেখছি, বদলে যাওয়া যাওয়া রং দেখছি তখন ঠিক সেই দুপুরটা ফিরে এলো। মাস্টারমশাই এর মুখটা মনে এলো । মাস্টারমশাই এক দৃষ্টিতে নীলরংয়ের কাঁচের শিশির মধ্যে তুলি ডুবিয়ে সাদা কাগজের পাতায় একটি ফোঁটা দিলেন। তাতে খানিকটা জল মিশিয়ে তিরতির করে ছড়িয়ে দিলেন পাহাড়ের মাথায় মাথায়, তারপর ফিসফিস করে স্বগতোক্তির মতো বলতেন,”এটা হলো টারকোয়াইস ব্লিউ !” বৈদুর্য মনির মতো সেই উজ্জ্বল নীল সেদিন থেকে মনের কোথাও একটা নতুন নাম নিয়ে ফেলেছিলো! সেই রঙের নাম , ছুটি ! আজ এই মুহূর্তে গাড়ির কাঁচে ছুটির ছায়া ফেলে ফেলে আকাশের এই নীল রং আমায় পালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই কোন অতীতে!
……আসলে বাসনা মরতে মরতেও মরে না। ছেলেবেলায় বেড়ানোর ইচ্ছেটা খুব প্রবল ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি ছিল না, তাই সেই ইচ্ছেগুলোর প্রকাশ ঘটতো আঁকার খাতায় কিংবা লেখার পাতায়। কিন্তু মন জুড়ে যে ইচ্ছেকুসুমগুলো সুপ্ত ছিল আজ তারা ফুল হয়ে ফুটেছে ঠিকই তবুও সে সময়ের অগাধ বিস্ময়, অপূর্ণ আকাঙ্খা এখনো হয়তো পুরোপুরি মেটেনি। তাই যেকোনো আন্তরিক পর্যটনে গেলেই আমার মনে পরে আমার চৌখুপি ঘরের একমাত্র জানলাটা, যেটা দিয়ে মনে মনে যতদূর ভ্রমণ করেছি, তার কানাকড়িও বোধহয় এই এতখানি ঘুরেও করে উঠতে পারিনি। রাস্তার পাশের মাইলস্টোন বলছে আর কালুক পেরিয়ে আর এক কিলোমিটার গেলেই রিনচেনপং। খানিকটা জিরোনোর জন্যে দাঁড়ালাম। ছেলেরা এবং গিন্নিও বেশ অস্থির হয়ে উঠছিলেন। আসলে এতখানি রাস্তা চড়ার এই অভিজ্ঞতা আমাদের সমতলের মানুষদের জন্যে বেশ ধকল বৈকি। যেখানটায় দাঁড়িয়েছি সেখান থেকে চোখে পড়ছে নীলের বহুমাত্রিক স্তরে প্রায় রঙ্গমঞ্চ খোলার মতো পর্দা সরিয়ে সরিয়ে দুপাশ থেকে খাড়া নেমে গেছে পাহাড়ের সারি। শেষ বিকেলের আলোয় গোধূলির রঙের সাথে রং মিলিয়েছে ফিকে চাঁদ। অবন ঠাকুরের ছবির মতো টেম্পারা রঙে আঁকা সেই না নীল, না গোলাপি , না বেগুনি সবকিছুর মাঝমাঝি ভীষণ মনখারাপিয়া সে রং। আমার প্যালেটে ছিল কিনা জানিনা, হাতের কাছে জলরং পেলে একবার চেষ্টা করে দেখা যেতে পারতো, ঠিক ওই রংটি খুঁজে পেতাম কি ? অনেক নিচের পাহাড়ি গ্রাম থেকে বোধহয় সন্ধ্যের উনুনের আঁচ পড়েছে, সেই সাদা ধোঁয়া গোধূমের মতো স্তরে স্তরে উঠে এসেছে উপরের দিকে। পাহাড়ের বুকে জ্বলে উঠছে একটি দুটি সন্ধ্যের আলো। আচ্ছা, নৈশব্দের কি প্রবল এক শব্দ আছে, সেটা আমরা পাহাড়ে বা জঙ্গলে না গেলে কেন যে বুঝি না ? এই যে এই মুহূর্তে টুপ্ করে এক ফোঁটা জল পড়লেও আমার কান ধরে ফেলছে সে শব্দ, সেই কান শহরে এতো বুজে থাকে কেন? বেশ স্পষ্ট শুনছি জঙ্গলের ওপর থেকে থেমে থেমে ডাকছে সম্ভবত পাহাড়ি দোয়েল। কথা থেকে যেন ভেসে আসছে প্রাথনা সংগীত, বৌদ্ধ গান , সব ! মাথার ওপর দিয়ে ফরফর করে উড়ে গেলো উৎসাহী কয়েকটা টিয়ে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার তাড়া লাগলেন, এরপর অপেক্ষা করলে রিসোর্টে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে। ভেবে দেখলাম, আশংকা অমূলক না! তাই আবার রওয়ানা।
ঘড়ি ধরে আর তিরিশ মিনিটের মাথাতেই বাসায় পৌঁছলাম। বাসাই বটে। আমরা যেখানে থাকবো, এই জায়গাটি আদপে একটি হোমস্টে। পোশাকি নাম, দি নেস্ট। নেস্ট বলতেই ঠিক যেমন ‘নেস্টলে’র লোগোটা মনে পরে, একটা বেশ ছোট্টখাট্ট পাখির বাসায় মা পাখির সাথে ছানা পাখি জড়োসড়ো হয়ে বসে, এই হোমস্টেটি ঠিক সেইরকম। ঢালু রাস্তাটা ঠিক যেখানে মোড় ঘুরছে সেইখানেতেই ছোট্ট তিনতলা বাড়ি। কি ছিমছাম। রাস্তার একদিকে বিরাট বিরাট রঙিন প্রার্থনা পতাকা, তার ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে একটা বেশ বড়সড় মনাস্ট্রি। আর আরেকদিকে আদিগন্ত পাহাড়, গাড়ি থেকে নামার আগেই একটি বিশেষ দিকে আঙ্গুল তুলে ড্রাইভার ছেলেটি দেখালো, ‘ কাঞ্চনজংঘা উদ্ধার দিখতা হ্যাইন” সে তো বুঝলুম, আপাতত সে জায়গায় রাশি রাশি মেঘ, তবু অনেক আশায় বুক বেঁধে রইলাম , রাত পেরোলেই যেন দেখতে পাই তাকে। সুন্দরী কাঞ্চনজংঘা! যার রূপে এ পর্যন্ত কত পর্যটক মোহিত হয়ে, বারবার ছুটে এসেছেন হিমালয়ের বুকে। দেবতাত্মা হিমালয়ের ঐশী সুন্দরী কাঞ্চনজংঘা !
নেস্ট নামেই হোটেল , আসলে ওই যাকে ইংরিজিতে আমরা সমঝদারের মতো বলি ‘হোম এওয়ে ফ্রম হোম’, নেস্ট হলো এক্কেবারে তাই। মিঃ এন্ড মিসেস যোগী এই বাসার মালিক ও মালকিন, দুজনেই ভারী আমুদে মানুষ। সমতল থেকে অতখানি উপরে এমন অতিথিবৎসল দুজন মানুষ এতো উষ্ণ অভ্যর্থনা জানাবেন, সেটা চিন্তাভাবনার বাইরে ছিল। এ তো শুধু নীরস কাগজে খসখস করে সইসাবুদ করে গাঁটের কড়ি খসিয়ে হোটেলের ঘরে চেকইন করা নয়, এ যেন কতদিন পরে দেখা হওয়া পাহাড়ে থাকা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে হঠাৎ পদার্পন। সাদা ঘরের পোশাকের ওপর ফুলফুল ছাপ এপ্রোন জড়িয়ে হাতে খুন্তি নিয়ে কিচেন থেকে মোটাসোটা হাসিখুশি ভদ্রমহিলাকে বেরোতে দেখেই নিমেষে মনে পড়লো মিলানের সেই কোকিলকণ্ঠী গায়িকা’কে ! কার কথা বলছি মনে পড়ছে ? হ্যাঁ, টিনটিন কমিকসের সেই অমর চরিত্র সিনিওরা বিয়াঙ্কা কেস্ট্যাফিওর ! উচ্চকিত গলায় ও দীর্ঘ দুহাত বাড়িয়ে তিনি স্বাগত জানালেন আমাদের, সঙ্গে তার পুত্র, যার সাথে কলকাতা থেকে হোয়াটস্যাপ এ আলাপচারিতা চলেছিল এতক্ষন, সেই সন্দীপ। লম্বায় ছফুট এর উপর লম্বা, ব্যাঙ্গালোর থেকে গ্রাফিক্স নিয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং ভারী নম্রভাষী। যোগী দম্পতি দুজনেই স্কুলের শিক্ষক।সারাদিন স্কুল, দফতর সামলিয়েও হাসিমুখে অতিথিদের জন্যে পান থেকে চুনের সব বন্দোবস্ত করে চলেছেন। আমরা বাঙালিরা কি সত্যি কখনো এদের মতো এমন পরিশ্রমী ও অতিথিপরায়ণ হতে পারবো, কে জানে? মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে হিসেবের বাইরে দুচারজন এলেই দেখেছি গিন্নিদের কপালে বেশ ভাঁজ পরে। তবে হ্যাঁ, এরা থাকা খাওয়ার জন্যে খরচ নিচ্ছেন ঠিকই কিন্তু এই যে আত্মীয়ের মতো নরম আপ্যায়ন, সেটা কিন্তু শত পয়সা খরচ করেও অনেক দামি জায়গায় মেলেনা ! আমাদের ঘরে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে মিঃ.যোগী তোয়ালে, সাবান আরো টুকিটাকি কিছু এবং সুদৃশ্য ডিজাইন করা মুখ ঢাকা দুখানি কাপে গরম চা নিয়ে নিজেই হাজির। একটা বেশ মজার জিনিস, এঁদের পিতাপুত্র এমনকি যে ছেলেটি হাতে হাতে জুগিয়ে দিচ্ছে সব, সবার মুখের মধ্যেই যেন একটা আধোহাসিমাখা কৌতুক মাখা গৌতম বুদ্ধের মুখের মতো ছাপ। সেটা অবশ্য আমার দেখার চোখটা বাঙালি চোখ বলে কিনা জানিনা, আমি সব পাহাড়ি মানুষের মুখের মধ্যেই বুদ্ধদেবের ছাপ খুঁজে পাই। আসলে পাহাড়ের সংস্কৃতির সাথে, দিগ্দিগন্ত ছড়িয়ে থাকা শান্তধী, স্নিগ্ধ, ক্ষমার মতো, হাসির মতো, সন্তুষ্টির মতো প্রকৃতির সাথে বুদ্ধদেবের কোথায় জানি একটা যোগ আছে। তাই পাহাড় মানেই মনাস্ট্রি যেমন অঙ্গাঙ্গি, আশেপাশে কোথাও ঠিক আছে ঠিক তেমনি বুদ্ধদেবও মিলেমিশে আছেন একটু একটু করে পাহাড়ের ভূমিপুত্রদের সব্বার মধ্যে।
গরম জলে স্নান সেরে সোজা রুফটপে দৌড়লাম সকলে। গরম গরম ধোয়াঁ ওঠা ভাত, ডাল, মাছভাজা আর নানারকম শাকসবজি দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ বিকেলে সেরে এবার সোজা ঘরে ! ঘরের বর্ণনা কি দিই ! তিনদিক প্রায় খোলা এ ঘরের লাগোয়া একটি ছোট্টখাট্ট ব্যালকনি, একেবারে পাহাড়ের কোলের মধ্যে, যেখানে সোহাগ করে এক কাপ চা নিয়ে চোখ বন্ধ করে বসুন। গায়ে থাকুক পাতলা উলের গরম চাদর একখানি। মাথা, কান ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে এবার চোখ খুলুন দেখি। হ্যাঁ, ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকলে আপনার চোখের সামনে অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য, হাতের এক্কেবারে নাগালে জ্বলজ্বল করবেন নগাধিরাজ হিমালয়। মাথাটা ডানদিকে থেকে বাঁদিকে যতখানি ঘোরানো যায় ঠিক ততখানি রেঞ্জেই দেখতে পারেন কাঞ্চনজংঘার সোনালী গোলাপি নয়নাভিরাম শৃঙ্গের ওপর শেষ সূর্যের সোনার মতো বিভা। সামনের পাহাড়ের গাঢ় সবুজ, নীল যেন এ দৃশ্যের ধরতাই ধরে খামখোলা এলবামের রমণীয় মলাট ! যদিও এই মুহূর্তে নীলচে পাহাড়ে সন্ধ্যে নেমেছে শীত মেখে। ফুটকি ফুটকি আলো আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে পাহাড়ের গায়ে, প্রাণের উত্তাপ মেখে। ঠান্ডা ভিজে হাওয়ায় দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও যেন পড়লো হাতের তেলোয়। ঘরে ফিরে ভারী পর্দা সরিয়ে আগল খুলে দিলাম। জানলার ভিজে কাঁচের শার্সিতে তখন লেপ্টে আছে ঝাপসা আলোর ডিফোকাস্ড পাহাড় আর দুয়েকটা পথভোলা জঙ্গলফেরত প্রজাপতির থিরথিরে শরীর। পথশ্রমে চোখের পাতা বুজে আসছে সকলেরই। তাই বিছানায় গা এলিয়ে কম্বলে পা অবধি ঢেকে যতক্ষণ চোখ খুলে রাখা যায়, সামনের জানলা ছাড়িয়ে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম। শিরশিরে হাওয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে ততক্ষনে তীরের ফলার মতো বৃষ্টি শুরু হয়েছে সন্ধ্যের পাহাড়িয়া আকাশে।খেলনাপাতি আলোর বিন্দুগুলো তখন মেঘপিয়নের দেশে ঝাপসা থেকে ঝাপসা হয়ে মিশে যাচ্ছে কোন পাহাড়, জঙ্গল ছাড়িয়ে অচিনপুরের রূপকথায় ! ঘরের আলো নিবিয়ে পাশের ঘরের কোনো বাঙালি পর্যটক কাঁচের গালে গাল ঠেকিয়ে ততক্ষনে বৃষ্টি দেখতে দেখতে গাইছেন….”এমনি বরষা ছিল সেদিন….. !!” চোখ বুজে এলো !
কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা, মাঝরাত নাগাদ যখন ঘুম ভাঙলো, তখন পূর্ণ চাঁদের মায়া। পাহাড়, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশার পাহাড়ি ঠিকানা তখন আদরের ঘুমে এপাশ থেকে ওপাশ ফিরে শুলো । জানলা ঠেলে খুলতেই একরাশ শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া ছুঁয়ে গেল। এতো আলো চারদিকে ! পাহাড়ের মাথায় মাথায় সন্ধ্যাদীপ জ্বলছে যেন দীপাবলির জমজমাট রাত। সন্ধ্যের মেঘলা পাহাড়ে যাদের এতো অলৌকিক, অনিশ্চিত আধো জ্বলা , আধো নিভে যাওয়া রহস্যের মতো দেখাচ্ছিল, মধ্যরাত্রির মালকোষে সেই রূপশহর যেন অনিমিখ বাতিঘর। আকাশ প্রায় পরিষ্কার। ত্রয়োদশীর চাঁদের আলোয় ভাঙা ভাঙা দুধগোলা জলের মতো অস্বচ্ছ কুয়াশার অথবা মেঘের এক একটা পাতলা স্তর ভেসে গেছে তিন পাহাড়ের চুড়োর ওপর দিয়ে। সকাল হাওয়ার আর বোধহয় খুব বাকি নেই। পুব দিগন্তে তার আগমনবার্তার নিশ্চিত আভাস। এমন বদলে যাওয়া চারপাশ, হঠাৎ করে এই হিরণ্ময় নীরবতা আমাদের আদ্যোপান্ত কথায় মোড়া শহুরে মানুষদের কেমন অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মনে হয়, এমন নৈশব্দের রাতে খাতা খুলে বসি। এমন নক্ষত্র খামারে একলা রাতে নেমে যাই, ঘুমন্ত শিশুর পাশ থেকে, ঘুমন্ত নারীর পাশ থেকে সোনালী নৈঃশব্দে হেঁটে যাই ঢালুপথ ধরে কোনো এক অজানা অচেনা অরণ্যানী ধরে, তথাগতের মতো। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা কেন জানি মনে পড়লো হঠাৎ ! এই এমন রাতে কেন সে ডাকলো, সে অনন্ত কুয়ার চাঁদ !
এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন
পৃথিবীর সমস্ত রঙিন
পদ্যগুলো নিয়ে যাবো, নিয়ে যাবো শেফালির চারা
গোলাবাড়ি থেকে কিছু দূরে রবে সূর্যমুখী পাড়া
এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র খামারে নবান্নের দিন।
যদি কোনো পৃথিবীর কিশলয়ে বেসে থাকা ভালো,
যদি কোনো আন্তরিক পর্যটনে জানলার আলো
দেখে যেতে চেয়ে থাকো, তাহাদের ঘরের ভিতরে
আমাকে যাবার আগে বোলো তাও, নেবো সঙ্গে করে ।
ভুলে যেয়োনাকো তুমি আমাদের উঠানের কাছে
অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে!
না, কাঞ্চনজংঘা দেখা দিলো না। অবগুন্ঠনে মোড়া রহস্যাবৃতার মতোই খানিক তার আভাসে এলো, খানিক এলো কল্পনায়। তাকে দেখবো বলে রাতভোরের অপেক্ষাকে নেহাতই তুচ্ছ করে সূর্যোদয় হলো, কিন্তু মেঘের পসরা সাজিয়ে। যা অধরা, তার রূপ স্বভাবতই বহুগুনে বাড়ে! ভোর হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম, রূপকথার রিনচেনপং কে হাতের তেলোর মতন করে দেখবো বলে। হোটেলের ঠিক ডানদিকেই যে মনাস্ট্রি, তার পিছনে তখন শুরু হয়েছে রঙের খেলা। ঈশ্বর কে যারা অবিশ্বাস করেন, তাদের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি, ঠিক ওই মুহূর্তের নৈসর্গিক রং, আলো, ঘ্রান উপলব্ধি করলে বোধহয় ঈশ্বরকে দেখার অনুভব টুকু পাওয়া যায়। মেঘ ছেঁড়া আলোয় তখন রশ্মির পর রশ্মিতে আকাশ উদয়রাগে রাঙা। একচিলতে সরু পথ ধরে ভেজা ঘাসের আলস্যে ভরা পাহাড়িয়া বাঁকে হারাচ্ছিলাম নিজেকে , রূপকথা তখন আনাচকানাচে।
– কুশল ভট্টাচার্য্য –