ভাগিরথীর তীরে নবাবের দেশে


সুবা বাংলার নবাবী আমলের উত্থান পতনের ইতিহাস ছড়িয়ে আছে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত ইতিহাস প্রসিদ্ধ মুর্শিদাবাদে।পায়ে পায়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের হাতছানি আর যেদিকে তাকাবেন প্রাচীন সৌধ গুলো আপনাকে বারবার নিয়ে যেতে চাইবে নবাবী ঐতিহ্যের কাছে।শিয়ালদহ থেকে রাত ১১:৩০ এর লালগোলা প্যাসেঞ্জার ভোর ৪ টে নাগাদ আপনাকে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে নামিয়ে দেবে।এছাড়াও কলকাতা স্টেশন থেকে আছে হাজার দুয়ারী এক্সপ্রেস।ওখান থেকে টোটো করে হোটেলে গিয়ে রেস্ট নিয়ে ফ্রেস হয়ে ব্রেকফাস্ট করে বেড়িয়ে পড়ুন মুর্শিদাবাদ ইতিহাস জানতে। প্রধানত দু থেকে তিন দিন রাখলে ভালোহয় যদি আপনি পুরো মুর্শিদাবাদের ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান গুলো দেখতে চান।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ঘোরার জন্য আপনি টোটো এবং ঘোড়ায় টানা টম টম গাড়ি এই দুটি সাহায্য নিতে পারেন।তবে ঘোড়া গাড়িতে করে নবাবী দরবারে যাবার থ্রিলই আলাদা । বিশাল লোহার গেট পেরোলেই দেখা যাবে জাহান কোষা কামান ।মুঘল সম্রাট শাহজাহানের রাজত্ব কালে বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁ ১৬৩৭ সালে জনার্দন নামক কর্মকার দ্বারা নির্মাণ করেন।যার ওজন ৭টন এবং দৈর্ঘ্য সাড়ে পাঁচ মিটার।এটা থেকে কামান দাগতে ১৭ কেজি গানপাউডার লাগতো।

পরবর্তী গন্তব্য কাটরা মসজিদ।এটি তৎকালীন সময়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছিল। গম্বুজ গুলিতে পাহাড়াদার থাকতো। এখন এটি Archeological Survey of India দ্বায়িত্বে। এখানে একটা সুড়ঙ্গ আছে,ভিতরের সৌন্দর্য আশ্চর্য করে।এখানে মুর্শিদকুলি খাঁর সমাধি আছে যা নবান নিজেই মৃত্যুর আগে বানিয়ে ছিলেন।আর আছে নবাব কন্যা আজিমুন্নিসা র সমাধি।কথিত তাঁকে সম্রাট জীবন্ত কবর দেন কারণ তিনি তাঁর জটিল রোগ সারাতে প্রতিদিন একটা বাচ্চার কলিজা খেতেন।যদিও এই কল্পকাহিনীর সাথে বাস্তবের কোন মিলই নেই তবুও এই গল্পে বিশ্বাস করে আজও বহু টুরিস্ট আজও ভীড় করেন এই কলজে খাকির সমাধি দেখতে।নিচে সমাধি ক্ষেত্র আর ওপরে এক মসজিদের দুটো ভাঙ্গা দেওয়াল।শোনা যায় এক ভয়ঙ্কর ভুমিকম্পে মসজিদ সম্পুর্ন ধ্বংশ হয় শুধু থেকে যায় দুটোমাত্র দেওয়াল যা আজও সেদিনের সাক্ষ্য বহন কড়ছে।

এখান থেকে যেতে হবে কাঠগোলা প্যালেস ১৫৫ বিঘা এই বাগানে ঢুকতে আপনাকে টিকিট কাটতে হবে।এটি নির্মাণ করেন লক্ষী পথ সিং দুগার ,তিনি ভাগীরথি নদীর তীরে জমিদারি ও ব্যবসা দেখাশোনা জন্য এখানে একটা রাজবাড়ী নির্মান করান যা আজ মিউজিয়াম পরিনত হয়েছে।ব্রিটিশ আমলের জিনিষ থেকে শুরু করে নবাবি আমলের পালঙ্ক,খাবারের বাসন ও আরও অনেক কিছু যা দেখতে দেখতে প্রায় ঘন্টা খানেক সময় কেটে যাবে।এই কাঠগোলাপ বাগানের অন্যতম আকর্ষন মুক্ত আঙিনায় নাচমহল, জৈন মন্দির ও এক প্রাচীন সুরঙ্গ ।সুরঙ্গ এখন জলে ধাকা।প্রবেশপথে লোহার দরোজা যা আজ বন্ধ।শোনা যায় গভীর রাতে এই পথেই নাকি যাতায়াত করতেন নবাব থেকে জগৎ শেঠ।এই সুরঙ্গ পথের অপর প্রান্ত নাকি জগৎ শেঠের বাড়িতেই মিশেছে যদিও আজ সত্যি মিথ্যে কোন যাচাইএর সুযোগ নেই । তবুও লোহার খাঁচার এপাশে দাঁড়িয়ে কল্পনায়এক লহমায় পৌঁছে যেতে পারেন সেই নবাবি দিনগুলোতে।

এরপরের দেখার জন্য অবশ্যই যেতে হবে বহু চর্চিত ধনী ব্যবসায়ী চরিত্র জগৎ শেঠের বাড়ি। জগৎ শেঠ কোনো একজনের নাম নয়।এটি একটি উপাধী।নবাবের সময়ে এঁরা মুলত ব্যাঙ্কের ভূমিকা পালন করতেন।বাড়িতে একটা ট্যাঁকশাল তৈরি করেছিলেন এঁরা । ১৭৫৭এর পলাশীর যুদ্ধে সিরাজ কে হারানোর জন্য রবার্ট ক্লাইভ ,আমির চাঁদ, মীরজাফররা মিলে যে ভয়ানক চক্রান্ত করেছিলেন তাতে প্রধান ভুমিকা গ্রহন করেছিল এই জগৎ শেঠরাই।

এরপরেই আছে নশিপুর রাজবাড়ি যেটি নির্মাণ করে দেবী সিংহ।দেবী সিং কুখ্যাত ছিলেন তাঁর অত্যাচারের জন্য।বাড়িটি অনেকটাই হাজারদুয়ারীর আদলে তৈরি।এখানেই দেবী সিংহ থাকতেন ,বিচার সভা বসাতেন ,খাজনা দিতে না পারলে চুড়ান্ত অত্যাচার করতেন এমন কি মিথ্যে অভিযোগ এনে তাঁদের ফাঁসিও দিতেন ।একটি ঘরকে এখানকার গাইডরা ফাঁসি ঘর হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। এখোন এখানে একটি কৃষ্ণ মন্দির ও কিছু প্রাচীন পেন্টিং আছে।

রয়েছে জাফরগঞ্জ সমাধীক্ষেত্র যেখানে সপরিবারে শুয়ে আছেন মীরজাফর ।উল্লেখ্য এখানে মোট ১১০০ সমাধী আছে এবং তা মুলত নবাব পরিবারের বিভিন্ন মানুষের।এসব দেখতে দেখতে সময় অনেকটাই পেরিয়ে যাবে।বিকেলের দিকে হাজারদুয়ারী চত্বরে আসতেই হবে নইলে মুর্শিদাবাদ ভ্রমন অসম্পূর্ন থেকে যাবে।বিশাল এই সবুজ গালিচায় মোড়া এক মাঠ।রয়েছে ঘড়ি টাওয়ার। একটা সময় বলা হত এটা দেখেই নাকি ভাগীরথী নদীর মাঝিরা সময় নির্ধারণ করতো। রয়েছে বাচ্চাওয়ালী তোপ।শোনার যায় এই কামান দাগার শব্দে মায়েরা সন্তান প্রসব করে ফেলতেন এমনই ভয়ানক ছিল এই কামানদাগার শব্দ।

মাঠের এক প্রান্তে হাজারদুয়ারী আর অন্য প্রান্তে বিরাট ইমামবাড়া।সিরাজের তৈরী হাজারদুয়ারী কবেই ভাগীরথির জলে তলিয়ে গেছে ।এখন যে হাজারদুয়ারি আছে তা নির্মান করান নবাব নাজিম হুমায়ুন জা ।ব্রিটিশ আর্কেটেক্ট ডানকান ম্যাকলয়েডের নেতৃত্বে ঊনিশ শতকে এটি তৈরী হয়।এটি এখন একটি মিউজিয়াম।

পড়ন্ত বিকেলে অবশ্যিই যেতে হবে ভাগীরথির অন্যপাড়ে খোশবাগে যেখানে চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজঊদ্দোল্লা । পাশেই শুয়ে আছেন প্রানপ্রিয় বেগম লুৎফুন্নেসা। নবাবের সমাধীতে একটি গোলাপ রেখে আসার সময় যখন গাইড আপনাকে নবাবের প্রতি বিস্বাসঘাতকতার গল্প শোনাবে তখন আপনার অজান্তেই চোখ ভিজে যাবে নবাবের বীরত্বের কাহিনী শুনে।শেষবিকেলে তখন ভাগীরথিরও রঙ লাল। সুর্যদেব তখন অস্ত যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।এভাবেই ইতিহাসের মুর্শিদাবাদে কাটিয়ে দিতে পারেন সারাটা দিন।
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জার ট্রেন।ও কলকাতা ষ্টেশন থেকে হাজার দুয়ারী এক্সপ্রেস মুর্শিদাবাদ যায়। এছাড়া ধর্মতলা থেকে বাস এর ব্যবস্থা আছে।থাকার জন্য রয়েছে নানান বাজেটের হোটেল।আগে থেকে বুক করেও যেতে পারেন অথবা গিয়েও হোটেল বুক করতে পারেন।

(English) Hotel Info



শেয়ার করুন
Brush

আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ