গন্তব্য গড়পঞ্চকোট


এক একটা সময় আসে, যখন বড্ড হাঁফিয়ে উঠি! চোখ মেলেই ভাবি, আজ কটার ট্রেন ধরতে হবে, অমুক মিটিং কটায়, তমুকের সাথে দেখা করা, ওই কাজটার ডেডলাইন জানি কখন? এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অবিকল আগের দিনের মতই আরো একটা দিন কেটে যায়। রাতে শোয়ার সময় হঠাত মনে হয়,আরে, আজ তো সারাদিন আকাশটাই দেখা হয়নি….ক্লান্ত মন বলে আর পারছি না, এবার চেনাপথ
থেকে পালাই। সেই একঘেয়ে ঘুম থেকে উঠে, নাকেমুখে গুঁজেই অফিস দৌড়োনো আর অফিস থেকে ফিরেই, পরের দিনের প্রস্তুতির এই চর্বিতচর্বনের অভ্যেস আক্রান্ত যাপন থেকে মুক্তি চাই! আর সেই মুক্তি পেতে পালাতেই হয়! পালাতে হয় নিজের থেকে, নিজের সামাজিক চেনা পরিচয় থেকে, চেনা অভ্যস্ত রাস্তার চোখরাঙ্গানি থেকে, চেনা ঘড়ির শাসন থেকে অন্য কোথাও, অন্য কোনখানে। এমন একটা কোথাও যেখানে কেউ আমায় চেনে না, এমন কোনো অসামাজিক, অভৌগোলিক অমরায়, যেখানে আমরা নিজেরাও নিজেদের চিনি না! ইউটোপিয়া জায়গাটা কি পৃথিবীর ম্যাপে আছে? আসলে দিবাস্বপ্ন নয়, এই তৎক্ষণিক বিচ্ছেদটা খুব জরুরি। কারণ এমন একটা কাঙ্খিত বিচ্ছেদ
থেকেই আসে নিজের সাথে অনেকটা নতুন করে সংযুক্তি! মনের দরজা খুলে পৌঁছনো যায় আসলে নিজেরই মনের সেই নিভৃতিতে, যে বাড়ির চেনা রাস্তা এতদিন ভুলিয়ে রেখেছিল ব্যস্ত জীবন! তাই চললাম!
এবারের রংরুট, গড়পঞ্চ কোট! জায়গাটা পুরুলিয়ায়! ধুসর সবুজ পাহাড়ের কোলে অনেকটা ইতিহাস আর অধিকন্তু নির্লিপ্তি নিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে! খুব যে একটা ভ্রমনপিপাসুদের ক্যালেন্ডারে পরিচিত, তা নয়! তবে, ভালো লাগার প্রচুর উপকরণ আছে! হাতের কাছেই জয়চন্ডি
পাহাড়, মাইথন লেক, পাঞ্চেত বাঁধের দিগন্তব্যাপী জলাধার। পলাশ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে শাল, তমাল,মহুয়া আর কুরচি ফুলের গাছ বন্ধুর মত দুহাত বাড়িয়ে আছে! মল্লরাজাদের বিরাট বিরাট কেল্লার ধংসাবশেষ এ থমকে যাওয়া ইতিহাসের গন্ধ ।বৃষ্টির দাক্ষিণ্য পেলে এ সমস্ত জঙ্গলে প্রাণ আবার ফিরে পায় নিজের হারিয়ে যাওয়া সব ভালোলাগাদের!

ওহো, এই জায়গাটার অন্য খুব চেনা একটা পরিচয়ও রয়েছে,যেটা ইশকুলে পড়া ভূগোলের বাইরে।সত্যজিত রায়ের হীরক রাজার দেশে তো আমরা সব্বাই দেখেছি নাহক পাঁচবার। সেই যেখানে গুপি বাঘা, হাতে তালি দিয়ে পৌঁছয় হীরক রাজ্যে, পাহাড়ের কন্দর থেকে গুহার অন্ধকার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে উদয়ন পন্ডিত আর রাজার পেয়াদারা ধাওয়া করে, সেই পাহাড়, সেই নদী, সেই গুহা আসলেতে গড়পঞ্চকোট। তাই কটা দিন এবার সভ্যতার সাথে সম্পর্ক….না, শেষ নয়, তবে মুলতুবি রইলো। আপাতত চললাম। এই গলালাম ভুতের রাজার দেওয়া জুতোয় পা। আর হাতে হাতে তালি দিয়ে, সো-ও-জা হীরক রাজ্য…..থুড়ি, গড়পঞ্চকোট !

"খোকা ঘুমোলো, পাড়া জুড়োলো, বর্গী এলো দেশে / বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে !!"ছড়াটা খুব ছোটবেলায় শুনেছিলাম ! হয়ত পড়েছিও অনেক গল্পে উপন্যাসে, কিন্তু সত্যি বর্গী কারা, তা নিয়ে সেভাবে খোঁজ করে দেখা হয়নি কখনো। কিন্তু বাংলারই প্রত্যন্ত পুরুলিয়ার তেলকুপি অঞ্চলে এখোনো এই বর্গীদের অত্যাচারের নিদর্শন ছড়িয়ে আছে আনাচে কানাচে ! তখন আলীবর্দী খানের
রাজত্ব বাংলার বুকে, সময়টা ১৭৪০ খ্রিষ্টাব্দ।রাতের আঁধারে ফুটকি ফুটকি মশালের আলো, আগুন।

জঙ্গলের সীমানা থেকে ছুটে এলো টগবগিয়ে ঘোড়া! মারাঠা সৈন্যদের দল, এদেশের সাধারণ মানুষের ভাষায় যাদের 'বর্গী' বলা হত, সেই তারা ঝাঁকে ঝাঁকে আক্রমন করলো পুরুলিয়ার কাশিপুরের রাজা সিংদেওর জঙ্গলমহল, গড়পঞ্চকোট ! লন্ডভন্ড করে দিল পঞ্চরত্ন মন্দির, লক্ষী মন্দির ,মনসামহল, রাজার দালানকোঠা, প্রাসাদ দেউড়ি সব! বর্গীরা দখল করলো রাজার সাত রানিকেও।সন্মান রক্ষার্থে, রাতের আঁধারে সাত রানী ঝাঁপ দিলেন প্রাসাদ দেউড়ির ভিতর গোপন ইঁদারায় !লুটপাট হয়ে গেল বহুমূল্য জেওয়ার, ধ্বংস হয়ে গেল সিংদেও রাজত্বের অপূর্ব সব নির্দর্শন, বিলীন হয়ে গেল সাত রানীর সাত মহলের চাকচিক্য ! আজ সেসব কালের গর্ভে, নিঃশব্দ ইতিহাস।ঝোপেঝাড়ে আর সাপের আড্ডায় মিশে থাকা এই জায়গায় নতুন সংস্কারে ঝকঝকে পঞ্চরত্ন মন্দিরটা যদিও বেমানান লাগছিল তবুও ইতিহাসকে এভাবেই বোধহয় আঁকড়ে থাকাটা জরুরি, নইলে সময় যে কাউকেই ক্ষমা করে না!স্থানীয় যে কিশোর ছেলেটি আমাদের এসব শোনাচ্ছিল, সে নিজেও খুব বেশি কিছু জানে না। তারও সবটাই শোনা। কিন্তু গড়পঞ্চকোট এলে এই ইতিহাস আপনাকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবেই হাতের কাছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অশ্রুত কাহিনীর আখ্যান, অদেখা অতীতকে ফিরে দেখার শিহরণ! সঙ্গের ছবিগুলো সেই টগবগে অতীতের অসহায় শেষ নিদর্শন।
পঞ্চকোটগিরির রেফারেন্স কিন্তু আজকের নয় ! এমনকি স্কন্দপুরাণেও পাবেন । তিলকম্প অথবা তেলকুপী ছিল মানভূম জেলার অন্তর্গত বানিজ্য রাজধানী। পাঞ্চেত বাঁধ এবং সংলগ্ন পাহাড়কে ঘিরে সে অঞ্চলের কেনাবেচার প্রধান কেন্দ্র। দাক্ষিণাত্য পাহাড়ের পাদপুরান করে সিংদেও রাজাদের রাজধানী ছিল এই গড়পঞ্চকোট ! ঐতিহাসিক ভাবে দেখতে গেল এ অঞ্চলের মন্দিরগুলি মূলত বিষ্ণুপুরের আটচালা প্রকৃতির ! টেরাকোটার অদ্ভূত শৈলীতে 'জোড় বাংলা' ধাঁচের এই মন্দির গুলিতে আরাধ্য দেবতাকে স্থাপন করা হত মন্দিরের গর্ভগৃহে। পঞ্চরত্ন মন্দিরটিও আদতে ছিল বিষ্ণুমন্দির। এটিকে কেন্দ্র করে উত্তর পশ্চিমে ও দক্ষিনে লক্ষী মন্দির, মনসা মন্দির , শিব মন্দির ও ছিন্নমস্তা কালির মন্দির তৈরী হয়। আজ সেসবই ইতিহাসের গর্ভে। অদ্বুত্ভাবে লক্ষনীয় এই সিংদেও রাজা নিজে ছিলেন ঘোর শাক্ত। তাঁর উপাস্য দেবী ছিলেন মহাকালী কল্যানেশ্বরী। তাই তাঁর কালির মন্দিরগুলি তৈরী হয়েছিল পাথর কুঁদে কুঁদে কিন্তু সেই তিনিই চৈতন্যদেবের ভাবধারায়
পরবর্তীকালে আপ্লুত হন এবং খাঁটি বিষ্ণুপুরি ধারায় কৃষ্ণ স্থাপনা করেন চূড়ান্ত বৈষ্ণবীয় ভাবধারায়, যার ফলশ্রুতি এখানকার টেরাকোটা মন্দিরগুলি !

শুনলে অবাক লাগে, জগদবিখ্যাত মধু কবি ( মাইকেল মধুসূদন দত্ত ) ১৮৭২ সালে এই সিংদেও এস্টেটের ম্যানেজার পদে নিযুক্ত হন। যদিও সে সময়কাল সামান্যই; তবুও মাইকেলের রচিত বেশ কিছু কবিতায় এই পঞ্চ কোটের অস্তিত্ব রয়েছে।এখন যেটুকু রয়ে গেল তা পাহাড়ের শিরোনামে কোনক্রমে দাঁড়িয়ে থাকা অতীত গরিমার অবলুপ্তির শেষ চিন্হ টুকু। যেখানে শুধু বসে থাকা যায় আর ইতিহাসের
মুখোমুখি প্রশ্ন তোলা যায় ! সিংহ দুয়ার অথবা সিং-দুয়ার তো সেই রূপকথার গপ্পতে পড়া। কিন্তু গড় পঞ্চ কোটে এলে সে সিংহ
দুয়ার আপনি নিজের চোখেই দেখতে পাবেন। শোনা যায়, এ অঞ্চলে প্রায় ২০০০০ বর্গফুটের মধ্যে মহারাজা সিংদেওর প্রাসাদের চারপাশে ছিল ঘন বাঁশ গাছের জঙ্গল আর দুর্ভেদ্য পরিখা। সেই পরিখা পেরিয়ে ছিল এই সিংহদুয়ার যার দুই পাশে পাথর কুঁদে তৈরী বিরাট দুই সিংহের দুটি খিলান। সে সিংহ দুয়ার পেরিয়ে ৭ কিমি হাঁটলে তবে মিলত মূল প্রাসাদে ঢোকার চাবিকাঠি। আজ সে সিংহও নেই, নেই সেই
দুয়ারও। রয়ে গিয়েছে দুপাশে হেলে পড়া দুটি খিলানের স্থাপত্য!

মাথার ওপর তখন চাঁদিফাটা রোদ্দুর । গাড়িটা ছুটছে পুরুলিয়া বরাকর রোড বরাবর। আশেপাশে ইতস্তত মফস্বলে শহর ! সাধারণ পাড়া, মধ্যবিত্তের দোকানঘর, ঘর বারান্দা !ধু ধু রুক্ষ মাঠঘাট আর রাস্তার বুক চিরে রঘুনাথপুরের এই পথে মোড় ঘুরতেই যে অমন বিস্ময় লুকিয়ে আছে কে জানত !রাস্তার শেষেই মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এক বিরাট পাহাড় ! না, শুধু একটাই নয়, দুটো,তিনটে।..আরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গোটা চারেক টিলাও ! ভাবতেই অবাক লাগে, হীরক রাজার দেশে ছবির জন্যে ঠিক এই লোকেশনটাই খুঁজে বার করেছিলেন মানিক বাবু ! উত্তুঙ্গ পাহাড়, বড় বড় পাথরের ফাঁক দিয়ে এখান দিয়েই তো বেরিয়ে এসেছিলেন উদয়ন পন্ডিত। হাতে তালি দিয়ে গুপি বাঘ পৌঁছে গেছিল ঠিক এই জায়গাতেই তো ! নানারকমের অচেনা গাছ আর প্রাগতিইহাসিক শিকড়ের বুননে গুহার মুখগুলো প্রায় অন্ধকার!

জয়চন্ডী পাহাড়ের আরো একটি আকর্ষণ হলো এর মাথায় চন্ডী মাতার ও হুনুমানের মন্দির। প্রায় ৫১২ টি সিঁড়ি ভেঙ্গে পৌছতে হয় এই পাহাড়ের মাথায়। আর সেখান থেকে গোটা পুরুলিয়া জেলার ছবি, যাকে বলে চোখ জুড়োনো। মেঘের ছায়া আর রোদের লুকোচুরি তখন নকশী করা জল বিছিয়েছে গোটা শহরের ওপরে! সবকিছু দেখাচ্ছে, ছোট ছোট বিন্দুর মত, ছবির মত ছড়িয়ে আছে মুহুর্তেরা ! এমন জায়গায় এলে, নিজেকে ঈশ্বর মনে হয় অথবা ঈশ্বরের মত যাকিছু, সেসব মনে পড়ে ।

শেষ কবে শহর থেকে সূর্য ওঠা বা সূর্যাস্ত দেখেছেন বলুন তো ? অফিসের পিসিতে মুখ গুঁজে কাজ করার ফাঁকে চোখে পড়েছে কলকাতার স্কাই লাইনের অনেক ওপরে আস্তে আস্তে পাটে বসছে লাল টকটকে ডিমের কুসুমের মত সূর্য ? না, শহরের হাজার কাজের ডেডলাইনের ব্যস্ততায় এসব দেখার সময় কোথায় ! তাই সূর্য ডোবার দৃশ্য এখানে আমরা দেখি শুধু কম্পুটারের ওয়ালপেপারেই ! তবে লাল মাটির সরানে, সূর্যাস্ত দেখার দৃশ্য প্রায় অলৌকিক রকম সুন্দর! পাঞ্চেত বাঁধের ওপর হোক অথবা মুরান্ডি লেকের সামনে ! যেদিকে দু চোখ যায় শুধু
আপনি আর সূর্যদেবতা ! সামনে অন্তহীন সোনালী হলুদ জলের রেখার ওপরে স্থিরচিত্রের মত দু তিনটে মাছধরা নৌকো ! কালো সিলুয়েটে স্থির হয়ে রয়েছে ফুটকি ফুটকি বিন্দুর মত ! এইমাত্রই কালো পাহাড়ের পিছন থেকে ডানা ঝাপটিয়ে পাড়ি দিল এক ঝাঁক পাখি ! হু হু হাওয়ার সময়্সারনিতে এখন শুধুই সূর্যের সাত রঙের খেলা!সেই যেমন অবন ঠাকুরের ছবিতে দেখেছিলাম, তেমনি না নীল্ না কমলা, সে এক অপার্থিব রঙের মেশামেশি আকাশ জুড়ে ! সে দৃশ্য যেন তাৎক্ষণিক অথবা সে দৃশ্য যেন চিরকালীন ! পৃথিবীর সেরা থেকে সেরা সুন্দরীও এ
দৃশ্যের সামনে ম্লান ! অনেকক্ষণ বুঁদ হয়ে বসে থাকতে হয় ! তারপর অনুভব করা যায়, বাঁধের মাথার ওপর ফুটে উঠছে ত্রয়োদশীর এক ফালি চাঁদ, একটি একটি করে ফুল ফোটার মত ফুটে উঠছে তারাদের দল! কেউ কোত্থাও নেই, শুধু মাইল মাইল চরাচর জুড়ে শুন্যতা ! শুন্যতা নাকি পূর্ণতা ? পরম পূর্ণতার উপলব্ধি !

তেলকুপি গ্রামের নাম এর আগে শুনেছেন ? আমি তো শুনিইনি আর এমন সার্থকনামা গ্রাম চোখেও দেখিনি । পুরুলিয়ার এ সমস্ত গ্রামে এখনো অনেক জায়গায় বিদ্যুত আসেনি। তাই সন্ধ্যের অন্ধকার নামলেই তেলের কুপিই একমাত্র ভরসা ! আজকাল অবিশ্যি সোলার লাইট চালু হয়েছে ,তবে সে আর কটা বাড়িতে! কথা হচ্ছিল বছর চোদ্দোর বিশ্বনাথ বাস্কের সাথে! এইমাত্র ছাগল চড়িয়ে এলো । নিকষ কালো মুখের ছেলেটির ডাগর উজ্জ্বল দুটো চোখ বলে দিচ্ছিল ওর অজস্র স্বপ্নদের কথা। স্থানীয় ইস্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে ও। বড় হয়ে কি হতে চায় জিগ্গেস করতে খুব লজ্জার সাথে জানালো ও শহরে গিয়ে কাজ করতে চায় ! কি কাজ ? কে জানে ? যে কাজে পয়সা আছে ! ওদের পয়সার ভারী অভাব যে !

" যে পথ কোথাও নিয়ে যায় না কোনদিন , সেই পথে এসে ,একদিন দাঁড়িয়ে পড়লাম। গাছ থেকে গাছের পাতা, ঝরে পরলো, – ফাঁকা, লম্বা রাস্তা আমায় টেনে নিয়ে চলল আরও ভেতরে । যেতে যেতে চারিদিকে শুধু বসন্তের বাতাস আর বাতাস । যেতে যেতে পেলাম টেলিফোন – চিঠি পেলাম ,' ভালো আছেন তো ?' -তোমাদের সাথে কি ভাইসব আলাপ হয়েছিল কোনদিন ?…হতেও পারে ; তোমাদের সঙ্গে হয়ত আমি প্রতিদিন খেতে বসতাম রাত্রিবেলা ,তোমাদের সঙ্গেই হয়ত গান- বাজনা শুনতে যেতাম – ঘুমোতাম –
তোমাদের সাথেই তো……" – ভাস্কর চক্রবর্তী

'আমাদের প্রত্যেকের জীবনের ঘরের পিছন দিকের একটা ছোট্ট জানলা থাকে। অন্য সব দিনে সচরাচর সেই জানলা খোলা হয় না ! সবাই শুধু সদাব্যস্ত হয়ে জীবনের সামনের দিকের কপাট খুলি, ঝাড় দিয়ে সাফসুতরো করি ঘরদোর, রাস্তার দিকে তাকাই, সাবান কিম্বা চালের খোঁজে বেরিয়েও পড়ি। কিন্তু এক এক সময় এমন আসে যখন খুব নিভৃতি পাই, অনেকটা। তখন চুপিসাড়ে সবাই যখন ভাতঘুম দিচ্ছে
দুপুরের ঝোঁকে, তখন জীবনের পিছনদিকের ওই ঘরে গিয়ে, ওই জানলার কপাটটা খুলে ফেলি ! ও মা !! কেমন টলটলে জলে শৈশবের পানাপুকুর এখনো ঝকঝক করছে ! ওই তো ,ঐখানে ওই ডাবগাছের তলাটায় আমরা দোলনা বেঁধে কেমন খেলতাম। আর ওই যে, ওই….. পানা সরিয়ে সরিয়ে ঠিক মাঝখানের শান্ত কালো কাকের চোখের মত জলটায় !! ওখানে ডুব দিলেই যে পাবো সাত রাজার ধন এক মানিক !! কি আরাম! ' – চেনা পরিবেশ থেকে বেরিয়ে অচেনা আবহে গেলে আদপে আমরা ফিরে যাই চেনা ছোটবেলার আদরে। তখন সবকিছু আবার ঠিক মনে হয়। স-ও-ব। আর কোনো দুঃখ থাকে না, গজগজ রাগ, খচখচ অভিমান সব কেমন গুলিয়ে যায়, ভুলিয়ে যায়। সেই ছোটবেলার মত রোদের গায়ে রং লাগে, রাতের গায়ে স্বপ্ন! দুঃখী মেয়েটি আবার গাছ থেকে কৃষ্ণচূড়া ফুল পাড়ে, কানে গোঁজে আর কালো জলে পা মেলে আনন্দে দোলে, ছলাৎ ছলাৎ। দুঃখী ছেলেটি আবার ঢিলপ্যাঁচ খেলে গাছ থেকে পাড়ে আম। কালো মোষের পিঠে চড়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আবার তাদের ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়, মায়ের গর্ভে। আবার ইচ্ছে হয় নতুন করে জন্ম নিতে। নাহ, এখানে নয়, এখানে নয়, সেই যেখানে বৃষ্টি পড়ে, সেই যেখানে ……!
'এখানে বৃষ্টি হয়না, না ?'
-'অ, শেষ কবে হইনছিল (…… অনেকটা ভেবে ), উই গত মাসে ইক রাত ! উয়ার পরে আর কোই হলো ?
– তাহলে চাষ তো হয় না , নাকি ?
– কি কুরে হুবে? গেঁহু নাই, চাওল নাই। সঅব তো কিনতে হলো। উ, সরকার দু ট্যাকা কিলো চাল দিনছে,আমরা উও সব পাই নাই।
– ওই বান্ধের জলে মাছ ধরি, বাড়িতে গরু ,ছাগল আছে, উয়াদের খওয়াইতে হয় ! এত্তগুলা মাইনস আমরা। ম্যুদের লেগ্যে কুনো সরকার লাই গো !
– আপনার ছেলে তো মাধ্যমিক পড়ছে ? এত কষ্টেও পড়াশোনা করছে এটাই তো খুব আনন্দের ! তাই না ?
– হ, পৈরছে ! কি হবেক !
( চায়ের বড় স্টিলের গেলাসে ফু দিতে দিতে …)

– ইখানে কি কৈর্বেক ? উয়ারা তো চাষবাস কৈর্বেক লাই । বিজনেস কৈর্বে ? সরকার টাকা দিবে ?দিখা যাবে!
– বেশ, আপনার বাড়ির কয়েকটা ছবি তুলি ? যদি আপনার আপত্তি না থাকে ,তো ?
– হ, তুলেন। আপুনারা ট্যুরিস্ট আন্ছেন ! তুলেন। কি হবেক !
– আসি । ভালো থাকবেন । ওহ, আপনার নামটাই জিগ্যেস করে হলো না !
– ( এক গাল হাসি হেসে ) –
– লক্ষিনিবাস বাস্কে !
এইসব কথার কোনো মানে হয়না, যদি না লিখতে পারি শব্দ ! যদি না লিখতে পারি ভালবাসা….আসলে এই যে গাছে গাছে ফুল ফুটে আছে থরেথরে, বৃষ্টির শেষের নম্র শ্লোকের মত ঝুঁকে আছে রাশি রাশি,হাজার বর্ণের, হাজার হাজার কলস্বর নিয়ে এত ফুল, সেসব শব্দ লিখে প্রকাশ করা দুষ্কর, ওই ওরা কিন্তু আপনাকে ভালবাসা শব্দটার চিত্ররূপ দেখিয়ে দিল। দেখলেন কি ? ওদের প্রত্যকের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, কিছু সুর আছে, শুনতে পেলেন ? জলভারে দুলে দুলে জলের শিশুদের ছুঁড়ে ফেলার মধ্যেও কি অদ্ভূত এক দোলন মায়া আছে। দেখতে পেলেন ? কজনা পারে! ওদের এই যে অপূর্ব প্রকাশ, এ যদি আমাদের হত? আপনি, বললেন এ আর এমন কি, এ তো শুধু বিজ্ঞান মাত্র ! ও, তাই
বুঝি! বেশ তো, আপনিও মাটি মেখে দাঁড়ান না বাপু। টবের মাটিতে দুই পা পুঁতে হাত দুটোকে ছড়িয়ে দিন দিকি হাওয়ায় হাওয়ায়, ডালের মত! কই, শরীরে ফুল এলো?
শুধু বড় বড় অক্ষরে খুউব বড় বড় বোর্ডে 'ফুলের গাছে হাত দিবেন না । অযথা ফুল ছিঁড়িবেন না !'এইসব কথা লিখে সাঁটিয়ে না দিলে বুঝি চিরটাকাল আপনারা জেনে এসেছেন যে পট করে ডাল ভেঙ্গে,ফস করে ফুল ছেঁড়ার মত নির্মল আমোদ বুঝি আর একটিও নেই ! শুধু না দেখে, একটু অনুভব করুন দেখি ? শুধু না ছিঁড়ে ফুলের গায়ে আঙ্গুল ঠেকান দেখি? আর মনে মনে ফিসফিসিয়ে ওকে বলুন, ও বড্ড
সুন্দর। হাওয়ার ঝোঁকে হালকা পায়ে আসা নম্র কাঠবেড়ালির মত বলুন ওকে, তোমায় খুব ভালোবাসি !অকাতরে উড়তে থাকা পাতলা পাখার প্রজাপতির মত ওর চারদিকে ঘুরেই দেখুন না, ও থরথর করে খুশিতে একবার কেঁপে ওঠে কি না ?পাঞ্চেত পাহাড় ডানদিকে ছেড়ে আরও বেশ কিছুটা এগিয়ে গিলেন পুয়াপুর । পুয়াপুর থেকে গাড় সবুজ জঙ্গল যেদিকে দুহাত বাড়িয়ে হাতছানি দিছে, সেই রাস্তা ধরেই এগিয়ে যান। উঁচু নিচু ঢালো মসৃন পিচরাস্তার দুপাশে দু হাত বাড়িয়ে কেন্দুগাছ, কুর্চি, মহুয়া, শাল, তমাল আরও কত যে গাছের আত্মীয়স্বজন ! হলফ করে বলছি, রাস্তাকে আড়াআড়ি ভাবে পেরিয়ে যাওয়া একটা লালমুখো গিরগিটি অথবা ঢিমেতালে খেজুরগাছে চড়া কাঠবেড়ালি ছাড়া আর কিছুটি দেখতে পাবেন না ! তবে শুনতে পাবেন।

গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করলেই শুনতে পাবেন, খানিকটা থেমে থেমে খানিকটা রয়েসয়ে কিরকির করে ঝিঁঝির ডাক, অবশ করে দেওয়া নৈশব্দে দূর থেকে কানে আসবে পাহাড়ি ময়নার কিচিরমিচির অথবা এক ঝাঁক টিয়ার ডানা ঝাপটিয়ে হঠাত উড়ে যাওয়ার ঝটপট শব্দ। নৈশব্দের মধ্যে যে এত্ত ক্যাকফনি রয়েছে, জঙ্গল না থাকলে আমরা সেসব মোটে জানতাম না ! গড় পঞ্চকোটে থাকার জায়গা খুব বেশি নেই। বনবিভাগের বাংলোটি ছাড়া আরো দু তিনটে! তবে এই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনবিভাগের বাংলোটি বড় চমত্কার জায়গায়। মূল রাস্তা থেকে দুপাশে জাল ঘেরা জঙ্গুলে রাস্তায় লাল হলুদে মেশে শুকনো পাতায় ঢাকা রাস্তায়, বাংলোর বিরাট গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দু বার হর্ন দিলেই, কালো মত খাকি
হাফপ্যান্ট পরা চৌকিদার ছেলেটি শশব্যস্তে উঠে এসে সেলাম জানিয়ে গেট খুলে দেবে আর ….আর কি ? আপনি তখন ডাইরেক্ট 'জাম্প কাটে' সো-ও-জা অরণ্যের দিনরাত্রির সৌমিত্তির চ্যাটার্জি। ঠোঁটের ডগায় সিগারেট ঝুলিয়ে বলেই ফেলুন, 'ইঁহা পে রেহনে কে লিয়ে কামরা মিলেগা চৌকিদার ?'কামরা তো বুকিং করেই এসেছেন সেই কলকাতা থেকে। এখন আর আপনাকে পায় কে? ঘরে ঢুকেই সামান রেখে আরমোড়া ভেঙ্গে বাইরের খোলা জায়গায় এসে দাঁড়ান তো! যদ্দুর চোখ যায় কার্বন ব্লু আকাশ আর আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে ঘুমোচ্ছে এক বিরাট সবুজ পাহাড়। যাবেন নাকি, চার বন্ধু মিলে ওই জঙ্গলের পথে? এখনিই , যাবেন ?
একটা বিরাট অর্জুন গাছ। গাছের গোড়াটা সুন্দর করে সাদা পাথরে বাঁধানো। টেরাকোটার একটা পরশুরামের মূর্তি রাখা আছে ঠিক গাছের নিচটায়। গাছ থেকে ঝিরি ঝিরি ফুল, পাতা খসে পড়ে ওই মূর্তির পায়ে, রোজ। পরশুরামই কি না জানি না, না হলে কোনো অরন্যদেবতাই হবেন। তবে ঠিক ওই জায়গায় উনি বড্ড মানানসই।এই বনবিভাগের কর্মকর্তাদের এসথেটিক সেন্সের তারিফ করতে হয় কিন্তু ! ঠিক যেন,
বিভূতিভূষণের আরণ্যকের পাতা থেকে উঠে আসা একটি চরিত্রকে কেমন সুচারু ভাবে ওখানে স্থাপন করেছেন তারা।
জায়গাটার মূল আকর্ষণ এঁর নির্জনতা। ওই যে সাদা বেঞ্চটা দেখতে পাচ্ছেন,ওখানে বেশ খানিকক্ষণ পায়ের ওপর পা তুলে চুপ করে বসলেই টের পাবেন, আপনি বসে আছেন গাছেদের অলস বেলার কানাকানির ঠিক মাঝখানে। শেষ দুপুরের ফিসফিসে হাওয়ায়, সামনের গাছে গাছে কথা চলছে, কানে কানে। খসখস শব্দে খসে পড়ছে শুকনো পাতা। সুরুত করে গাছ থেকে নেমে আসছে চালাকচতুর কাঠবেড়ালি আর গাছের গোড়ার ওর গোপন আস্তানায় উঁকি দিয়েই ওর দোসরকে নিয়ে চলে যাচ্ছে অভ্যস্ত ব্যস্ততায়। দুটো দোয়েল মগডালে চড়ে শিস দিছে অনেকক্ষণ ! আরেকটু সন্ধ্যে নামলেই বাংলোর ঘরে ঘরে জ্বলে উঠবে আলো।সামনের পাহাড়ের আবহের সূর্যাস্তের আকাশটায় রং ধরবে অন্ধকারের। আর একটি একটি করে তারা ফুটে উঠবে সামনের গাছটার জুঁই ফুলের মত !কি করে ধরা যায় এসব? মোবাইলে ভিডিও রেকর্ডিং ? নাকি, খচখচ ছবি তোলা শুধু! সেসব তো আছে কিন্তু সে বড় প্রযুক্তির সাহায্য নেওয়া ! তার চেয়ে ভালো শব্দ, শব্দের ডানায় ভর দিয়ে ওরা প্রাণ
পায়। তার চেয়ে আরও ভালো রং আর রেখারা ! সঙ্গে তো কাগজ কলম রয়েছেই। এঁকে ফেলুন না !আমিও এঁকে ফেললাম, দু চার রেখায়, জায়গাটা খাতাবন্দী হয়ে রয়ে গেল চিরকালের মত। স্মৃতিদের কি আলাদা পাড়া থাকে?ঠিক এই জায়গাটায় বসেছিলাম ! ওই অর্জুন গাছের নিচে তখন সুগন্ধি হাওয়ার মাতাল করা রাত! রাত্রি বোধহয় প্রায় ১১ টা। বোধহয় কেন বলছি, কারণ সময়ের জ্ঞানটা তখন সত্যিই ছিল না। সন্ধ্যে
থেকেই সেদিন আমি বেপথু -' পাহাড়িয়া মধুপুরে বাতাসিয়া পথে, মধুবাতা ঋতায়তে, মধু ছিল সাথে !!
'না,শুধুই সুরা নয়, খানিকটা পানে আর খানিকটা গানে, সে ছিল নিজের সাথে নিজে দাঁড় বেয়ে বেয়ে যাওয়া উজানের পথে।বেশ কিছুটা শ্বাস নিয়ে, বেশ কিছুটা সময় নিয়ে চারপাশকে দেখা আর অনুভবের কোষে কোষে ভরে নেওয়া জীবনের গন্ডুষ।পাহাড় থেকে ভেসে আসছিল সম্ভাবনাময় আষাড়ের দমকা বাতাস।মেঘের মধ্যে বিদ্যুতও লুকিয়ে ছিল চিনচিনে ব্যথার মত, আভাস দিচ্ছিল মাঝে মধ্যেই চমকিয়ে , থেকে
থেকে রূপসীর কালো ঘন চুলের জালে যেমন ঝলকে ওঠে রুপোর কাঁটা, ঠিক তেমন ! মন থেকে কখন মুখে চলে এসেছিলেন রবি ঠাকুর। চোখ বুজেই গাইছিলাম, কত যে গান ভর করে এসেছিল প্রাণে ! গাইছি 'আজ যেমন করে গাইছে বাতাস,,,,' ঘোর ভাঙ্গলো বেঞ্চিতে অন্য কারো বসার শব্দে। ভদ্রলোক চুপটি করে বসে মোবাইলে রেকর্ড করছিলেন আমার ছাইপাঁশ গান ! চোখাচুখি হতেই বললেন, আপনার অনুমতিটি না নিয়েই কিন্তু এই গর্হিত কাজটি করে ফেলেছি। আপনার শেষ গাওয়া গোটা পাঁচেক গান এখন আমার
কব্জায়। হো হো করে হেসে যারপরনাই লজ্জিত হলাম।আলাপ হলো আমাদের মতই বনবিভাগের বাংলোর আরেক অতিথির সাথে। অত্যন্ত সুভদ্র এই মানুষটির নামও বড় অদ্ভূত, সংযোগ, উপাধিটা অবিশ্যি জিগ্গেস করিনি। সংযোগবাবুর সাথে আলাপ জমল আরও, গান নিয়ে, প্রাণ নিয়ে… ওঁর মায়ের কাছ থেকে, স্ত্রীর কাছ থেকে ফরমায়েস এলো আরও কত গানের …… গান গেয়ে গেয়ে, রাত কাটলো,
সুরের পানসি ভাসালো পুরুলিয়ার পাহাড়। খুব চমৎকার, ওঁর একটি কথা মনে পরছে, সেদিন বলছিলেন.."এই যে আপনি গাইছেন, এখানে কোনো বাজনা নেই, সঙ্গত নেই, কিন্তু যা আছে তা হলো এই ভূমা প্রকৃতি। এই চরাচরের মধ্যে আপনি গাইছেন একেবারে সেই তাঁর সাথে যুক্ত হয়ে, আর সেটিই সঙ্গীত,অর্থাত সম-গীত। যা ইশ্বরের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়, সেই গান।" ইশ্বরের সাথে পরিচয়
হওয়ার মত গুণ বা বৈরাগ্য আমার নেই, নেহাতই ছা-পোষা, সাদামাটা মানুষ আমি, কিন্তু সংযোগের মত মানুষদের সাথে সংযোগ ঘটার জন্যেও বোধহয়, এভাবেই বেরিয়ে পড়তে হয়।চেনা পথ ফেলে, অচেনা পথের হাতছানিতে পাড়ি দিতে হয়।

– কুশল ভট্টাচার্য্য –



শেয়ার করুন
Brush

আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ