আপনার ভাষা নির্বাচন করুন
কথায় আছে ‘গড় তো ব্যাস চিতোরগড়, বাকি সব গড়াইয়া’।
মেবারের রাজপুতদের বীরত্ব ও রানী পদ্মিনীর জহরব্রতের কাহিনী খ্যাত চিতোর। উদয়পুর থেকে সকাল ৯টার উদয়পুর-আজমের প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চড়ে সোয়া দুঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম চিতোরগড় (Chittaurgarh)। এখান থেকে দিল্লি ফেরার ট্রেন সেই রাতে। হাতে ঘণ্টা সাতেক সময় চিতোরের কেল্লা দেখে নেওয়ার। সময়টা ২০১১ সালের জানুয়ারীর শেষ সপ্তাহ। তিনদিনের একটা ছুটি পেয়ে, তৎকালিন দিল্লিনিবাসী আমি, হঠাৎ ঠিক করে চলে এসেছি মেবার অর্থাৎ দক্ষিণ রাজস্থানে – উদয়পুর ও চিতোর ভ্রমণে। স্টেশনে নেমে ক্লোকরুম খুঁজছি, মালপত্র রেখে কেল্লা দেখতে যাব বলে। এক অটোওয়ালা এসে সমাধান করে দিল। বলল যে সেই আমাদের কেল্লা ঘুরিয়ে সব কিছু দেখিয়ে, তারপর সন্ধ্যের মধ্যে স্টেশনে ফিরিয়ে দেবে। তার অটোতেই আমরা মালপত্র রেখে ঘুরতে পারব। নতুন শহরের এক প্রান্তে একটি সুদীর্ঘ পাহাড়ের মাথায় গড় ১৫০ মিটার উচ্চতায় অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে প্রাচীর ঘেরা ঐতিহাসিক চিতোরের কেল্লা। কেল্লা তো নয়, যেন একটা শহর। পুরোটা ঘুরতে নাকি ১৩কিমি পথ অতিক্রম করতে হয়।
স্টেশন থেকে ৩কিমি চলে গাম্ভিরি নদী পার হয়ে পৌঁছলাম কেল্লার পাহাড়টির পাদদেশে। এবার খাড়াই রাস্তা। প্রথমে একটা সুপ্রাচীন ফটক। নাম ‘পাদল পোল’। এরপর বাঁক খাওয়া খাড়াই রাস্তা বেয়ে আরো পাঁচটি গেট পেরিয়ে সপ্তম গেট ‘রামপোলে’ পৌঁছলাম। এগুলি সবই কেল্লার পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বার। উপর থেকে একদিকে কেল্লার ভিতর ‘রাণা রতন সিংহের প্রাসাদ’ ও আরেক দিকে নিচের উপত্যকা ও চিতোর শহরের দৃশ্য দারুণ উপভোগ্য। এরপর একটা ছোট বসতি পার হয়ে কেল্লার মূল অংশে প্রবেশ। ৭০০ একর জায়গায় গোটা কেল্লা জুড়ে রয়েছে সেযুগের বহু প্রাসাদ ও সৌধ বা তার ভগ্নাবশেষ, বহু প্রাচীন মন্দির, কুন্ড, ৮৪টি ছোট জলাশয়, একটি মিউজিয়াম ও কিছু জনবসতি। মেবার রাজপুত বাপ্পা রাওয়াল রাজ্যপাট শুরু করেন সপ্তম শতাব্দীতে পত্তন হওয়া চিতোরের কেল্লায়। ১৫৬৮ সাল অবধি চিতোর ছিল মেবারের রাজধানী।
“Maati Baandhe Painjanee../ Bhangdi Pehne Baadli../ Dedo Dedo Baavdo../ Ghod Mathod Bhavdi…”
চেনা চেনা ঠেকছে গানের লাইনগুলো? এটা TV তে দেখানো রাজস্থান ট্যুরিজমের বিজ্ঞাপনের সেই সরকারি থিম সং। এই মনমাতানো রাজস্থানী ফোক গানটির সাথে একাত্ম হয়েই শুরু করা যাক কেল্লা পরিদর্শন।
প্রথম গন্তব্য কুম্ভশ্যাম ও মীরাবাই মন্দির। একই কম্পাউন্ডের মধ্যে পাথরের উপর খোদাই করা অসাধারণ ভাস্কর্যের দুটি মন্দির। রাণা কুম্ভের দ্বারা ১৪৪৮ এ নির্মিত মন্দিরটিতে উপাস্য দেবতা শ্যাম অর্থাৎ কৃষ্ণ। আরেকটি মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের উপাসনা করতেন মীরাবাই, যাঁর বিবাহ হয়েছিল মেবারের রাজপুত বংশে। শ্রীকৃষ্ণের উপাসনায় নিবেদিত মীরার ভজন গুলির সৃষ্টি এই চিতরের কেল্লায়।
এরপর ‘জহর কমপ্লেক্স’ ও তার পাশে ‘বিজয় স্তম্ভ’। এটিই চিতোর কেল্লার মূল আকর্ষণ। জহর (Jauhar) গেট দিয়ে প্রবেশ। ভিতরে জহর গ্রাউন্ড ছাড়াও অনেকগুলি দ্রষ্টব্য। অটোওয়ালাই আমাদের গাইড। নাম তার সামাধ। বাগানের মধ্যে দিয়ে বামদিকে খানিক চলে পাহাড়ের গা কেটে বানানো একটি প্রাচীন মন্দির। পাথরের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ‘গৌমুখ কুন্ড’। ন্যাচারাল স্প্রিং। বহু বছর ধরে জল পরে চলেছে পাহাড়ের গা থেকে নিরন্তর। কুন্ডে শিব লিঙ্গ। কুন্ডের মিষ্টি জলে নাকি রয়েছে অনেক গুণ। কুন্ডের জলে তৈরি, তিন দিক পাথরের প্রাচীরে ঘেরা, গাঢ় সবুজ রঙের ছোট জলাশয়টির ওপারেই খাদ ও অনেক নিচে চিতোর শহরের অনবদ্য দৃশ্য। কুন্ড দেখে ওপরে এসে দুটি পরিত্যক্ত মন্দিরের পাশ দিয়ে চলে একটি বাদামি বেলে পাথরের তৈরি বিশাল শিব মন্দির। কোনারক শৈলীর মন্দির গাত্রে, বাইরে ও ভিতরে, পাথরের গায়ে খোদাই করা অনবদ্য কারুকাজ। মন্দির দর্শনের পর এবার রানী পদ্মিনীর সেই ‘জহর কুন্ড’। যা ভারতের ইতিহাসের এক অসামান্য গৌরব ও বেদনাময় কাহিনীর সাক্ষী। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি চিতোর আক্রমণ করে রাণা রতন সিংহকে পরাস্ত করে। রতন সিংহের স্ত্রী, সেযুগের অসামান্য সুন্দরী রানী পদ্মিনী। লোলুপ আলাউদ্দিনের হাত থেকে নিজেদের সম্মান বাঁচাতে, বহু রাজপুত রমণীকে সঙ্গে নিয়ে রানী পদ্মিনী আগুনে আত্মাহুতি দেন বা জহর (Jauhar) ব্রত পালন করেন এই কুন্ডেই। পাশেই রয়েছে আরেকটি কুন্ড – ‘সতী কুন্ড’।
চত্বরটির অন্যদিকে রাজপুত বীরত্ব ও শৌর্যের আরেক নিদর্শন ৩৭ মিটার উচ্চতার, ৯ তলা বিখ্যাত ‘বিজয় স্তম্ভ’ বা ‘Tower of Victory’। মুসলিম শাসকদের থেকে চিতোর পুনরোদ্ধার করে, ১৪৫৮ সালে রাণা কুম্ভ নির্মাণ করান এই বিখ্যাত বিজয় স্তম্ভ। ভিতর ও বাইরে অসংখ্য কারুকাজে মোড়া অসাধারণ সুন্দর এই স্তম্ভটি কুতুব মিনারের থেকেও সুন্দর।
ইতিহাসের মাঝে অনেকক্ষণ হারিয়ে থাকার পর আবার চড়ে বসলাম সামাধের অটোয়। পথের দুপাশে কয়েকটি প্রাসাদের ধ্বংশাবশেষ ও ছোট জলাশয়। পাহাড়ের উপর জলকষ্টের হাত থেকে বাঁচতে সেযুগে বানানো হয়েছিল জলাশয়গুলি। ডানদিকে ভগ্নপ্রায় একটি বাড়ি, এক বীর সেনাপতি ফাট্টার নামে – ‘ফাট্টা প্রাসাদ’ ও তার বিপরীতে ‘ফাট্টা ট্যাঙ্ক’। আর একটু এগিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ‘কালিকা মাতা মন্দির’। অষ্টম শতাব্দীতে তৈরি কারুকার্যময় মন্দিরটি ছিল নাকি সূর্য মন্দির। এখন উপাস্য কালিকা মাতা। অল্প দূরেই রাস্তার বিপরীতে জলনিবাস ‘পদ্মিনী প্যালেস’, যা আরেক ঐতিহাসিক কাহিনীর সাক্ষ্য বহন করে। ছোট একটি জলাশয়ের মাঝে দোতলা ছোট্ট মহলটিতে গ্রীষ্মকালে এসে থাকতেন রাণা রতন সিংহ ও তাঁর স্ত্রী রানী পদ্মিনী। জলের এপারে মহলের ঠিক পাশে দোতলায় ছোট ঘরটিতে রয়েছে চারটি আয়না, ঈষৎ হেলানো। কিংবদন্তী, রানী পদ্মিনী ছিলেন সে যুগের সবচেয়ে সুন্দরী। দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন একবার চিতোরের কেল্লায় এসে দেখতে চেয়েছিলেন পদ্মিনীকে। চুক্তি রক্ষার্থে, রতন সিংহ নিচের মহলের দরজায় দাঁড় করিয়ে এই ঘরের আয়নায় পদ্মিনীর প্রতিচ্ছবি দেখিয়ে আলাউদ্দিনকে সাময়িক ক্ষান্ত করেছিলেন।
এরপরের গন্তব্য ‘সূরয পোল’ – কেল্লার পূর্বমুখী গেট। নিচে দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ উপত্যকা। আজ কে বলবে যে নিচের ঐ উপত্যকাটি একসময় ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। নিচ থেকে উঠে আসা রাস্তাটি দিয়েই নাকি সবচেয়ে বেশিবার হামলা হয়েছে চিতোরের কেল্লায়। প্রকান্ড দ্বারের গায়ে ছোট ছোট বর্শার ফলা। শত্রু বাহিনীর হাতি যাতে গেট ভেঙে ফেলতে না পারে, তার জন্যই এই ব্যবস্থা।
এরপর আবার অটোয় চেপে আরেকটি স্তম্ভের সামনে। নাম ‘কীর্তি স্তম্ভ’। ২২ মিটার উঁচু এই সুন্দর স্তম্ভটি দ্বাদশ শতকে জৈন ব্যাবসায়ীরা নির্মাণ করিয়েছিলেন। পাশেই সুন্দর ভাস্কর্যের ‘দিগম্বর জৈন মন্দির’। আরো এগিয়ে একটি বড় কম্পাউন্ডের ভিতর ‘পীতাম্বর জৈন মন্দির’। অপূর্ব কারুকাজের কয়েকটি মন্দির ও জৈন সম্প্রদায়ের কিছু মানুষের বাস কম্পাউন্ডটির ভিতরে। পাশে অপেক্ষাকৃত নতুন, একটি বড় প্রাসাদ – ‘ফতেহ্ প্রকাশ প্যালেস’। উনবিংশ শতাব্দীতে তৈরি প্রাসাদটিতে রয়েছে একটি মিউজিয়াম। চিতোরের বেশিরভাগ সামগ্রীই রাজপরিবার নিয়ে গেছে উদয়পুর সিটি প্যালেস মিউজিয়ামে, যা আমরা গতকাল দেখে এসেছি। তাই সোমবার মিউজিয়াম বন্ধ থাকায় তেমন আক্ষেপ রইল না।
শীতের শেষে রাজস্থানের রোদ ভরদুপুরে একটু চড়া। অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু মন্ত্রমুগ্ধের মত আমাদের অটোওয়ালা কাম গাইডের সাথে ছুটে বেড়াচ্ছি কেল্লার বিভিন্ন প্রান্তে, যেন কিসের টানে। এবার শেষ গন্তব্য ‘রাণা কুম্ভের প্যালেস’। অটো থেকে নেমে, পাথরের রাস্তা বেয়ে খানিকটা উঠে প্রবেশ। রাস্তার বিপরীতে গোলাকৃ্তি কাঠামোটির নাম ‘ন-লাখ কি খাজানা’। এটি ছিল রাজকোষের অর্থভান্ডার। অষ্টম শতাব্দীতে বাপ্পাদিত্য প্রাসাদটি নির্মাণ করলেও, এটির সংস্কার করেন রাণা কুম্ভ। প্রাসাদের ভিতরে আজ অনেক ছোট বড় মহল ও কাঠামোর ভগ্নাবশেষ। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘উদয় সিংহের মহল’, ‘পদ্মিনী মহল’ ও একটি আস্তাবলের কাঠামো। একটি মঞ্চের মত জায়গা দেখিয়ে সামাধ বলল যে এখানেই নাকি একসময় শোভা পেত ৫০কেজি ওজনের সোনার সূর্য মূর্তি, যা আমরা এগের দিন দেখে এসেছি উদয়পুরের সিটি প্যালেসে। সূর্যের উপাসক রাজপুতেরা মেঘলা দিনে উপাসনার জন্য বসিয়েছিল ঐ মূর্তিটি। পদ্মিনী মহলের সামনে নিচে নেমে যাওয়া একটি সুড়ঙ্গের মুখে লোহার গেট। এই সুড়ঙ্গই নাকি চলে গেছে একটু আগে দেখে আসা ‘গৌমুখ কুন্ড’ পর্যন্ত। সেযুগে রক্ষণশীল সমাজে রানীদের স্নান করতে যাবার জন্য ছিল এই ব্যবস্থা। প্রাসাদের এক প্রান্তে একটু নিচে ‘দিওয়ান-ই-আম’। খানিক দূরে ডানদিকে ভগ্নপ্রায় ‘মীরাবাই মহল’। আর বামদিকে খানিক আগে দেখে আসা ‘কুম্ভশ্যাম’ ও ‘মীরাবাই মন্দির’ দুটি দেখা যাচ্ছে।
সামাধ এখনও তার কর্তব্য পালন করে চলেছে। বারবার তার মেবারের গৌরব গাথা শুনিয়ে চলেছে। রাজস্থানের আরেক রাজবংশ, মারোয়ারের রাজারা মোঘলদের সাথে আপস করলেও, মেবারের বীর রাজপুতরা দিল্লির শাসকদের সাথে কোনদিন আপস করে নি। দিল্লির সুলতানদের হাতে বারবার ধ্বংস ও লুণ্ঠিত হয়েছে চিতোর। কিন্তু মাথানত না করে রাজপুতরা সমানে লড়াই করে গেছে। নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে বারবার আত্মাহুতি দিতেও পিছপা হয় নি রাজপুত রমণীরা। মুঘলদের সাথে রাণা প্রতাপের নিরলস সংগ্রাম, হলদিঘাটির যুদ্ধ সর্বজনবিদিত। মধ্যযুগের ভারতের ইতিহাসে মুসলিম শাসনের একচ্ছত্র আধিপত্যের মাঝে হিন্দু রাজ্য মেবার মাথা তুলে স্বাতন্ত্র বজায় রেখে গেছে। শৌর্য, সম্পদ ও ঐশ্বর্যে ভরা ছিল চিতোরের কেল্লা। পরবর্তী কালে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে রাজধানী স্থানান্তরিত হয় কুম্ভলগড় ও তারপর উদয়পুরে।
যেন ইতিহাসের পাতায় ঘুরে বেরিয়ে কেটে গেল পাঁচ ঘণ্টা সময়। কত গৌরবের, কত বেদনার কাহিনি শুনেছি মন্ত্রমুগ্ধের মত। চমকিত হয়েছি। মুগ্ধ হয়েছি উচ্চমানের প্রযুক্তি, শিল্পকলার নিদর্শন দেখে, কেল্লার বিশালতায়। খুব সুন্দর ভাবে সব ঘুরিয়ে দেখিয়েছে অটোওয়ালা কাম গাইড সামাধ। ধন্যবাদ মানুষটিকে। এবার চিতোরের কেল্লা ছেড়ে নিচের বাস্তবে নেমে যাবার পালা। স্টেশনে পৌঁছে দিল্লির ট্রেন ধরা। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছে বিজয় স্তম্ভটি। শেষ বিকেলের পরন্ত আলোয় এই ভগ্নাবশেষের মাঝে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে যেন বহু বেদনার মাঝেও গৌরবের জানান দিচ্ছে।
-শুভাংশু দাসগুপ্ত-