আপনার ভাষা নির্বাচন করুন
ছোটবেলায় গরমের ছুটি বলতে আলাদা করে কোথাও যেতে হয়, খুব একটা হিল্লিদিল্লি ঘুরে বেড়াতে
হয়, তেমন কিছু জানতাম বলে মনে পরে না ! মানে গ্রীষ্মাবকাশ বলতে ঠিক যেরকম বানিয়ে বানিয়ে
রচনা লিখতে হতো যে এবছর গেলাম পুরী, গতবছর সিকিম… তখন তো আসলে সেরকমটি ছিল না,
আমার মনে পড়েনা বাবা বেশ তোড়জোড় করে কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেছেন, বড়জোর বৈদ্যবাটির
মামারবাড়ি বা খড়দার মাসিরবাড়ি, কিংবা ঝাড়গ্রামের মেজঠাকুমা… দৌড় ওই অবধিই! সেখানে
সমবয়েসী ভাইবোনদের সাথে খেলবো, কুঁদবো, পুকুরে দাপাদাপি করে স্নান করবো, আম পাড়ব.. এ
সমস্তই ছিল ছুটির অব্যর্থ অনুপান, তবে আমাদের পরের প্রজন্মের মানে আমার দুই পুত্রের কাছে
গরমের বা শীতের ছুটি মানেই তল্পিতল্পা বেঁধে ঘুরতে যাওয়া আছে। হয়তো বা ছোটবেলার আমাদের ওই
অপ্রাপ্তিগুলোই আবার ওদের শৈশবের মধ্যে দিয়ে ফিরে পেতে চাই বলে সেই ছুটির খোঁজে যাই আমরাও
! তাই আজকের বাঙালির কাছে দীপুদা অর্থাৎ কিনা দিঘা, পুরি, দার্জিলিং ছাড়িয়েও গুগল ম্যাপের
সীমানা অনেকখানি। এবারের ছুটির খোঁজে যখন মাস তিনেক আগে এমনিই দুম করে বন্ধু দেবাশীষ আর
সুমিতের সাথে স্টেশনে দাঁড়িয়ে লাল চা খেতে খেতে গরমের ছুটির লোকেশন নিয়ে প্ল্যান করছিলাম,
ভাবতে পারিনি সত্যি সত্যি জায়গাটায় গিয়ে উঠতে পারবো। হাজার হোক এ হলো ভারতের সেই
কেন্দ্রশাসিত রাজ্য, ছোটবেলায় ভূগোলের বইতে যার নাম দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করতাম,
‘অদিদাগআমিচপলা’ অর্থাৎ অরুণাচল, দিউ, দমন,গোয়া ….ইত্যাদি আরো পাঁচটি যাঁর প্রথমটি ছিল
অরুণাচল। অরুণাচল মানে জানেন তো? ভোরের প্রথম আলোর দেশ! কিন্তু জানার দৌড় ওটুকুই, ঐ
ভূগোল কিংবা গুগলের মাধ্যমে যতখানি তাঁকে জানি ততখানিই তাঁর সম্পর্কে আমার জ্ঞান। তাই
যাত্রার দিনক্ষণ স্থির হতে চাপা উৎকণ্ঠা ছিল যেমন স্বপ্ন ছিল আরো বেশি। তাই চালাও পানসি –
অরুণাচল। এই টুকরো লেখার কোলাজ গুলো সেই ডায়েরির পাতাগুলো উল্টে উল্টে দেখা, আমার
ক্যামেরার চোখ দিয়ে যেকটা মুহূর্ত ধরতে পেরেছি আর মেঘ রোদ্দুরে চু কিতকিত খেলার মধ্যে দিয়েই
জীবনের যে শটগুলো কোনোদিনও নেওয়া যায়না, কেবল দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাঁ করে দেখা যায়, তাদের গল্প
বলবো। বাকিসব একইরকম, বাকিসব রূপকথা।
হিমালয়ান ট্যুরিসমের থেকে ধারে ও ভারে অনেকটাই আলাদা উত্তর পুবের এই অরুণাচল পাহাড়ের
জায়গাটার মজা কোথায় জানেন, এখনো পর্যন্ত এখানে গড়পড়তা পর্যটকদের ঝাঁক সেরকমভাবে
ঝাঁপিয়ে পড়েনি, সবে বছর চার পাঁচেক ভ্রমণপাগল মানুষ সেখানে যাচ্ছেন। অবিশ্যি তার কারণ ও
আছে। একে তো যোগাযোগ ব্যবস্থা বলুন বা হোটেল, খাওয়াদাওয়ার সুব্যবস্থা বলুন অথবা সাইটসিয়িং
এর পাকাপোক্ত প্রফেশনালিজম, কোনোটাই অরুণাচলে এখনো পর্যন্ত আপটুডেট নয়। তাই
তুলনামূলকভাবে, উত্তর পুবের অন্যান্য ভিড়ে ভরা পাহাড়ি স্বর্গর মধ্যে, এখানে ভিড় সত্যিই কম।
তাই ইংরিজিতে যাকে বলে 'প্রিস্টাইন বিউটি' ঠিক সেই শুচিশুভ্র অনাঘ্রাত সৌন্দর্য এখনো পর্যন্ত
এখানে চারদিকে থরে থরে ছড়িয়ে। তবে একবার যখন ভূভারতের পর্যটকদের চোখে পড়েছে, বছর
পাঁচেক পরে ওখানে পাহাড়ের মধ্যে নিভৃত লেকের দুপাশে সার সার এগরোলের দোকান কিংবা খাস
এস্প্ল্যানেডের মতো থিকথিকে ভিড় দেখলে অবাক হবেননা ! যাইহোক, যাওয়ার তল্পিতল্পা বেঁধে
আমাদের দল ভারী করলাম বন্ধুবান্ধবদের আরো তিনটি পরিবার মিলে। আমি, আমার গিন্নি, আমার
শাশুড়ি মা এবং ছানাপোনারা আর আরো জুটে গেলো বন্ধু দেবাশীষ, পায়েল আর ওদের একরত্তি
দস্যিমেয়ে অদ্রিকা আর সুমিত,পিয়ালীর জুটি আর ওদের ধীরস্থির রাজপুত্তুর শৌনক। অরুণাচল ভবন
থেকেই বার তিনেক গিয়ে তদবির করে আমাদের এগারোজনের সমস্ত পারমিশন করানো হলো। সীমানা
পেরোলেই নাকি অন্তর্রাষ্ট্রীয় অনুমতি ছাড়া আপনি একপাও এগোতে পারবেন না। অরুণাচল ভবনের
এক আধিকারিকের কাছ থেকে ওখানকার এক ট্যুর অপারেটরের সাথে যোগাযোগ করে বাকি সমস্ত
ঠিক হল। অরুণাচলে দেখার জায়গা অনেক তবে পাহাড়ি রাস্তায় অনেক বাঁক, অনেক মোড় ঘুরে তবে
কিনা পৌঁছনো যায় সে রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে, তাই এখানে ট্র্যাভেল করার পদে
পদে বাধাও ঠিক সমান সমান। এখানে ঘুরতে গেলে ঠিক হনুমান টুপি পড়া, মাফলার কানে জড়ানো, ব্যাগে
ঝর্ণা ঘিয়ের শিশি নিয়ে ঘোরা বাঙালি হলে চলবেনা, বরং ওই ইংরিজিতে ব্যাকপ্যাকার বলতে ঠিক যা
বোঝায়, তেমনতর স্ট্রিট স্মার্টনেস ভারী দরকার। দস্তুরমতো শারীরিক ফিটনেস, যেকোনো পরিবেশ
পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নেওয়ার সৎসাহস আর পাহাড়ি পথের ভালোমন্দ সব সারপ্রাইজগুলোকে
মেনে নেওয়ার মত বুকের পাটা থাকলে তবেই এগোন। প্রায় বিধিসম্মত সতর্কীকরণ করে দিলাম।
কারণ আগে আগে আমরা কিরকম কিরকম পরিস্থিতে পড়লাম, সে গল্প শুনলেই মালুম হবে কেন একথা
বললাম~ যাইহোক, ট্যুরের সফরসূচির সম্পর্কে এখানে একটু বলে নেওয়া দরকার। আমাদের যাত্রাপথ
ছিল গুয়াহাটি থেকে ভালুকপং হয়ে দিরাং। সেখানে থেকে তাওয়াং এবং বমবডিলা হয়ে আবার গুয়াহাটি।
তবে এখানটায় একটু দম নিয়ে নিন, বুকে নিঃশ্বাস ভোরে নিন একটুখানিক কেননা ব্যাপারটা যতটা
শুনতে সহজ শোনাচ্ছে, ততটা কিন্তু নয়। গুয়াহাটি থেকে গাড়ি নিয়ে দুপুর তিনটে নাগাদ যাত্রাশুরু করে
প্রায় তেজপুর, দিশপুর, শোণিতপুর আর বাকি আসামের অনেকটা পেরিয়ে ব্রহ্মপুরের দিকদিগন্ত ছুঁয়ে
যখন আমাদের গাড়ি ভালুকপংয়ের দিকে ছুটছে তখনই ঘড়ির কাঁটা পেরিয়ে গেছে ঘন্টা সাতেক।
সেই যে বুদ্ধদেব গুহ লিখেছিলেন না, " প্রকৃতির মধ্যে এলে মন পাপড়ি মেলতে থাকে। যে কথা, যে কাজ
অন্য জায়গাতে করা যেত না, যা করার কথা ভাবাও যেত না, তাই করা যায়, ভাবা যায়। উই আর
অলওয়েজ ইন আওয়ার এলিমেন্টস হোয়েনেভার উই কাম টু নেচার। " বড় সত্যি কথা। ঠিক যে কয়েকটা
এলিমেন্টস দিয়ে আমরা তৈরী, অনুভবের সেই সবকটা স্তর বড় ঢেকে থাকে শহরের ধুলো ধোয়াঁর
আস্তরণে, সেগুলো রক্তমাংসের আমির এতো ভিতরে চাপা পরে থাকে, সে সেগুলোর অস্তিত্বই টের
পাইনা বড়। কিন্তু এই খোলা হাওয়া, এই উম্মুক্ত আকাশ, এই উদার আলোর বনপাহাড়ের পদাবলীতে,
পা রাখা মাত্রই শরীরে, মনের, রন্ধ্রে রন্ধ্রে একটা চাপা আনন্দ শুরু হয়ে যায়, একটা দুদ্দাড় খেলা
গোপনে গোপনে ইচ্ছেমেঘ হয়ে বেরিয়ে আসে। আমরা ফিরে আসি আমাদের কাছে, আমাদের অনুভবের
কাছে।
এই যে পাকদন্ডী বেয়ে বেয়ে পাহাড়ে চড়ছি , নিরবচ্ছিন্ন প্রায় পাঁচ ঘন্টা ধরে একবার ডানদিক ,
একবার বাঁদিক ঘেঁষে গাড়ি উঠে যাচ্ছে আকাশের আরো কাছাকাছি আর বুড়ি ছোয়াঁর দূরত্বের মতো
ইমাত্তর যে নীলচে সবুজ পাহাড়ের ওইপাশে দেখলাম একটা ছোট সাদা বুদ্ধিস্ট ইমারত ,ওমা চুলের
কাঁটার মতো মোড় ঘুরতেই সে দেখি আমার হাতের পাশেই। ওই যে ঝর্ণা দূর থেকে চিকচিক করছিলো
ইশকুল ফেরত মেয়েটার মাথার চুলের ফিতের মতন, কাছাকাছি এসে দেখো , কি খোলতাই তার রূপ, কি
ঝিলিক তার স্রোতে। যত উঠছি, তাপমাত্রা কমতে কমতে ততই বেশ মোলায়েম একটা আবহাওয়া তৈরী
হচ্ছে। সেই যে রবি ঠাকুরের শিলং যাত্রা, কি দারুন লিখেছিলেন, ' পাহাড়ে চড়িবার অনতিবিলম্বেই
গাড়ির মধ্যে খক খক, খুক খুক নানা প্রকার শব্দে মালুম হইলো পাহাড়ে পৌছাইয়াছি। গলায় গলায়
মাফলার উঠিল, কানে কানচাপা টুপি।" ….. ঠিক তাই। কে বলবে জোড়থাং অবধিও কি অসম্ভব গরম
পেয়েছি। তবে এ মুহূর্তে আমরা এক্কেবারে পাইনের জঙ্গলের পাতাঝরা পাহাড়ি পাকদন্ডী পেরিয়ে উঠে
যাচ্ছি ক্রমশ উঁচুতে, ইচ্ছেখুশির খাসতালুকে। পথে নৈঃশব্দ আর চোখ জুড়োনো প্রকৃতি, সঙ্গী বলতে
এই দুজন। গাড়ির সামনের কাঁচ মাঝেমধ্যেই ঢেকে যাচ্ছে সাদা ধোয়াঁর মতো গাঢ় কুয়াশায়। ঠিক যেন
ভোর পাঁচটার কাজলধোয়া আকাশ । এই আছে, এই সব সাদা, এক হাত দূরেও কিছুই চোখে পড়ছেনা
মোটে, আবার নিমেষেই দ্যাখো, সেসব উধাও। আরেকটা মোড় ঘুরতেই বিরাট বিরাট পাইনের সারির
মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে মাথা উঁচু করে দেখতে পাচ্ছি ঝিলমিল করে হাসছে আকাশছোঁয়া গাছের মাথায়
শেষ বেলার সালমা জরির মতো রাঙা রোদ্দুর।
এলিফ্যান্ট করিডোর পেরিয়ে যখন রাত্রির নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার চিরে দুভাগ করে হেডলাইটের
আলো জ্বালিয়ে যখন গাড়ি ছুটে চলেছে ভালুকপংয়ের দিকে তখন রাত অনেক। একটু আগেই
আদিগন্তবিস্তৃত ব্রহ্মপুত্র পেরিয়েছি। সামনে আরো প্রায় বিশ কিলোমিটার যাওয়ার পর
ভালুকপংয়ের বর্ডার। রাস্তায় মস্ত মোষের শিঙের আকারে বানানো প্রবেশদ্বার। চতুর্দিকে আর্মির
কড়া প্রহরা। আমাদের কাছ থেকে ইনার লাইন পারমিট ভালো করে দেখে নেওয়ার পর গাড়ি ছাড়লো ,
পরবর্তী গন্তব্য হোটেল ড্রুক। অন্ধকারে উঁচুনিচু রাস্তায় নিভু নিভু আলোয় আর গাছগাছালির
আড়ালে আবডালে সে হোটেল খুঁজে পাওয়া বেশ দুষ্কর। বেশ খানিক্ষন একে তাকে প্রশ্ন করার পর সে
পাওয়া গেলো একরকম। তারপর চটপট খাওয়াদাওয়া সেরে শুয়ে পড়া, একে পাহাড়ি জায়গা তায় রাত্রি
প্রায় দশটা, সময় এখানে মাঝরাত্তিরে মতন নিস্তব্ধ। সকালের ঘুমটা অন্যদিনের মতো সাত
তাড়াতাড়ি না ভাঙ্গারই কথা, তবুও মুরগির আওয়াজে আর সূর্যের আলোয় ঘুমটা ভেঙে গেলো বেশ
সকালে। পাহাড়ের একটা নিজস্ব আদর আছে, সে আদরে মনের ভিতরকার অনেক ক্ষোভ, দুঃখ, রাগের
ওপর মলম পড়ে। ঠিক কোথায় আছি সেটা মনে হতে চোখ মেলতেই ধড়মড় করে উঠে বসলাম । কাঁচের
জানলা দিয়ে কুয়াশা, মেঘ আর রোদ্দুর ভেদ করে দূরের নীল সবুজ পাহাড়ের সারি। চারদিকে কতরকম
পাখির শব্দ, গাছের পাতা থেকে টুপটাপ জল পড়ার শব্দ, নৈশব্দের শব্দ। ব্যাগ থেকে একটা পশমিনা
বের করে, গায়ে মাথায় ভালো করে জড়িয়ে ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালাম। মুখ থেকে একটাই
শব্দ বেরোলো, ছুটি ! নিজস্ব ছুটি।
ভালুকপং জায়গাটা গুগল ম্যাপের মধ্যে একটা ছোট্ট বিন্দুর মতো পাহাড়ি হ্যামলেট। এই যে
হোটেলের সামনের রাস্তাটা পাকদন্ডী বেয়ে বেয়ে উঠছে আর নামছে, সে ওঠানামার একটা অসমাপ্ত
ম্যাজিক আছে। এ ম্যাজিক কোনোদিন শেষ হয়না। শেষ হবার নয়! মাথার ওপরে দুবাহু মিলিয়েছে
কৃষ্ণচূড়ার লাল আর আদিগন্তে মেশা নীলে মিশেছে সে রোদ্দুর। দুপাশের রাস্তায় বাঁশ, পাথর আর
দরমার নানারকম কাঁচা পাকা বাড়ি। বাড়ির গেটে ঝুলছে বৌদ্ধ পতাকা। সকালের উনুনে কুন্ডলি পাকিয়ে
নীলাভ সাদা ধোঁয়া উঠে মিলে যাচ্ছে আকাশের ঝুলে থাকা মেঘেদের দলে। দরমার বেড়ার ফাঁক দিয়ে
বেরিয়ে আসছে মুরগির ছানা, ছোট ছোট ভেড়ার দল। জবাগাছের নিচে বসে রেডিও চালাচ্ছে লালছোপ গাল
ফুলো বাচ্চা। গম্ভীর মন্দ্রকণ্ঠে বৌদ্ধ গান ও যেন ভেসে আসছে সামনের কোথাও থেকে। আমাদের
বাচ্ছারা ছুটে লাগলো যে যেদিক পারে। ওদের নিজস্ব ছুটির সংজ্ঞা তো সেটাই। গাছেদের ক্যাসুরিনা
ঢাকা পথের কোনো শেষ নেই সেখানে, সেখানেই তো প্রতি বাঁকেই নতুন ছবি, প্রতি মোড়েই খুশির রুমাল
!
সামনের আরেকটা মোড়! মোড় ঘুরতেই সামনে ছোট্ট একটা মনাস্ট্রি। তরুণ লামারা হাতে জপের মালা
নিয়ে প্রদক্ষিণ করছেন গোটা মনেস্ট্রিকে, তাদের চোখ স্থির পায়ের দিকে, ঠোঁটের ডগায় বিড়বিড়
শান্তিপাঠ। সামনের উঠোনের চোর্তেন এর ঘুলঘুলিতে ততক্ষনে জ্বালানো হয়েছে ধুপ। সকালের
আকাশের নীলে পতপত শব্দে উড়ছে লাল, নীল, হলদে প্রার্থনাপতাকা! বেশ কয়েকটি গোলাকার
পাথরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে বৌদ্ধলিপিতে মন্ত্রের সারি। সামনের প্রায়ন্ধকর ঘরের দরজাটি
আধখোলা। চোখে পড়লো ধ্যানস্থ বুদ্ধমূর্তি। কোলের ওপর বাঁ হাতটি জড়ো করা, হাতে রাখা
ভিক্ষাপাত্র, আর ডান হাতে অভয়মুদ্রা। মূর্তির ডানদিকের দেওয়ালের উঁচুতে একটি ঘুলঘুলি থেকে
কৌণিকভঙ্গিতে মূর্তির কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সূর্যরশ্মির একটি আলোর স্তম্ভ। ঝিলমিলে সে আলোয়
প্রায়ান্ধকার সেই ঘরে তখন কি যে অদ্ভুত এক অশ্রুত সামগান, অশ্রুত করুনাধারা!
ভালুকপংয়ের এই অদ্ভুত নাম কোথা থেকে এসেছে, সেটা হয়তো অনেকেই জানেন, কিন্ত আমি জানতাম
না। তবে খানিকটা গুগল ঘেঁটে আর খানিকটা স্থানীয়দের মুখে শুনে, আমি তো হাঁ! একেবারে মহাভারতের
সাথে এমন অদ্ভুত সংযোগ! মহাভারতে বাণাসুরের নাম শুনেছেন তো? বানাসুর ছিল দানব বংশের শেষ
প্রতিনিধি পরম শিবভক্ত সেই অসুর, যার ছিল হাজারটি হাত। তৎকালীন প্রাগ্জ্যোতিষপুর অর্থাৎ
এখনকার অসম ছিল তার রাজ্যপাট এবং জলে জঙ্গলে ঘেরা এই ভালুকপং ছিল তার রাজধানী। তো এই
বাণাসুরের ঠাকুরদাদা ছিলেন রাজা ভালুক ! অনার্য দানববংশীয় এই দাপুটে রাজার নামেই এই জায়গার
নাম ভালুকপং। লোকশ্রুতি এখনো জঙ্গলের মধ্যে সে সময়ের ভগ্নস্তূপের বেশ কিছু স্মৃতিচিন্হ এখনো
নাকি রয়ে গেছে যার পাশ দিয়ে পা টিপে টিপে বয়ে গেছে তিরতিরে খরস্রোতা টিপি নদী। ভালুকপং ছাড়িয়ে
গাড়ি বোধহয় ৫ কিলোমিটারও এগোয়নি, রাস্তার পাশে কুলকুল করে বয়ে যাওয়া এ নদী, আমাদের
সদলবলে গাড়িছাড়া করলো। রাস্তা থেকে মিনিট দশেক লাফাতে ঝাঁপাতে বেশ খানিকটা নিচে নেমে নদীর
বুকে এক হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে তবে শান্তি। যতদূর চোখ যাচ্ছে, কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে খরস্রোতা।
সারাবছর এরকমই জল থাকে কিনা জানিনা, তবে এ নদী আর পাঁচটা পাহাড়ি নদীর মত শীর্ণ নয়,
স্বাস্থ্যবতীই বলা যেতে পারে ! একপাশে খাড়াই পাহাড়, পাহাড়ের পুরুষালি বুক বেয়ে নেমে আসছে বেশ
কয়েকটা তন্বী ঝর্ণার সরু ধারা আর তারা সোজা মিশছে এসে টিপি নদীর বুকে। এ নদীর বিশেষত্ব এর
বুকের নানা রঙের, নানা আকারের মুঠো মুঠো পাথর, জলের বুকে ওরা জেগে আছে শতাব্দীর আবহমান
আদরের চিন্হ নিয়ে। ওর কোনটা নীলাভ সবুজ, কোনটা আবার হলদেটে লাল। এতো রঙের পাথর সত্যি
বলতে আগে দেখেছি বলে মনে পড়েনা, মনে হলো ওদের সবকটাকে জমিয়ে বাড়ি নিয়ে আসি। বরফগলা
জলে পা ডুবিয়ে বসে মাথার ওপরের ইচ্ছেখুশির পাহাড়িয়া পাখির চরকিপাক দেখতে দেখতেই বেলা
গড়ালো অনেকটা।
পাহাড়ের একটা না ফুরোনো ম্যাজিক আছে, একটা গোটা মাস, বছর কিংবা হয়তো এক যুগ পেরোলেও সে
ম্যাজিক কোনোদিনই শেষ হয়না। ঠিক যেন এক অমোঘ আশ্চর্য ম্যাজিশিয়ান তাঁর শেষ খেলা দেখিয়ে
মঞ্চের উপর টুপি খুলে শেষ অভিবাদনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন দর্শকদের দিকে মুখ করে, অথচ
দর্শকেরা চুপ, হাততালি পড়ছেনা এখনো। খেলা এখনো আরো কি যেন বাকি, তাই সকলে আরো একটু
রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষায়। আমাদের এই পাকদন্ডী বেয়ে বেয়ে পাহাড় দেখাও ঠিক তেমনি। নির্বাক
মুগ্ধতার তখনো অনেক বাকি , কারণ পরবর্তী গন্তব্য দিরাং। দিরাঙে রাত্রিবাস একটি দিনের। সে
জায়গাটা কেমন তো জানিনা কিন্তু গন্তব্যের প্রতি আকর্ষণ আমার বরাবরই কম। বরং এই যে
দেখতে দেখতে চলা, এই যে প্রতি বাঁকেই নতুন ছবি, প্রতি মোড়েই খুশির রুমাল, এই ভালো !
হাতঘড়ি বলছে বিকেল পাঁচটা। মাঝেমধ্যেই রাস্তার অসম্ভব খারাপ চড়াই আর উৎরাই।
সপ্তাহখানেক আগেও ল্যানস্লাইড হয়ে শুনলাম কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে এই রাস্তায়। বিরাট বিরাট
শক্ত কালচে বাদামি পাথুরে মাটির চাই ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে রয়েছে গোটা রাস্তায়। আচ্ছা,
এইরকম ক্যানভাসের মতো যত্নে আঁকা প্রকৃতির কোলে মৃত্যু হলে তার বীভৎসতা কি একটু হলেও
কমে যায় ? কে জানে, খুব সুন্দরের কাছে এলে মানুষের মরতে ইচ্ছে করে শুনেছি! আমারও করে! কেমন
মনে হয় এখানেই লীন হয়ে, লগ্ন হয়ে শেষ হোক বাকিটুকু। জীবন ও মৃত্যুর একদম পাশাপাশি এই বিপুল
আয়োজনের পাশেই কোন অমরাবতী থেকে, কোন উত্তর থেকে পাথর ধরে ধরে একটুকরো তিরতিরে
স্রোত পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে সবুজ ছুয়েঁ ছুয়েঁ ঝরে পড়ছে ছোট্ট একটুকরো ঝোরার মতো। হঠাৎ মনে
হলো আমার তো ছোটবেলায় কোনোদিন পাহাড় দেখা হয়নি। তাই সন্তানের চোখ দিয়ে পাহাড়কে নতুন
করে দেখার আনন্দই আলাদা, ছেলে প্রশ্ন করে,
– ওই সাদা সাদা ফ্ল্যাগগুলো ? ওই যে পাহাড়ের ওপর ? কি বাবা ?
– ওই পাহাড়ের ওপরটা দেখতে পাচ্ছিস ?
– হু, আর তার একটু ওপরে ওই ছোট ঘরটা দেখতে পাচ্ছিস?
– হ্যা, পুরো জঙ্গল তো পাপা! তারমধ্যে একটা গ্রিন হাউস। আর একটা কিরকম লাইট জ্বলছে….না
পাপা? ওখানে কেউ থাকে ?
– ওটা গ্রিন হাউস না রে। শেওলা ধরে ধরে পাথরগুলো গ্রিন হয়ে গেছে। আসলে এখানে এতো বৃষ্টি পড়ে,
তাই সবসময় শেওলায় ভারী হয়ে থাকে চারপাশ! তবে ওখানে ছোট একটা লণ্ঠন জ্বলছে যখন নিশ্চই
কেউ থাকে। রোজ ওই ওতো উপর থেকে সাদা মেঘ, কুয়াশা ভেঙে ভেঙে সেই লোকটা নিচে নেমে আসে।
সেই লোকটার মাথায় বাঁধা থাকে একটা বিরাট ঝুড়ি। আর সেই ঝুড়ির মধ্যে থেকে উঁকি মারে একগুচ্ছ
পাহাড়। পাইন, ফার্ন, ঝাউগাছের পাতা, বার্চ গাছের ডাল, রডোডেনড্রন এর লাল টকটকে ফুল, তারপর
…তারপর ওই যে সবুজ ফুলগুলো রে, যেগুলো বেলা বাড়ার সাথে সাথে ব্লু হয়ে যায়, সেইসব, আরো কত
রকম পাতা গাছ, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, রোদ, ফুল, সওব নিয়ে সেই লোকটা পাহাড়ের ঘুরপথ ধরে নেমে
আসে, তারপর আমাদের সব আদর করে গিফট করে দিয়ে আবার চলে যায় ওর ওই ছোট্ট ঘরটায় !
তখন ইশকুলে পাহাড়ের ছবি আঁকতে দিলে ছবির এক কোনে ঠিক এইরকম সাদা আর নীল মোমরং ঘষে
ঘষে ফিতের মতো একটা ঝর্ণা আঁকতাম। মাঝখানে মাঝখানে মাথা উঁচু করা এবড়োখেবড়ো পাথর! কে
জানে, মনের কোন গহন কোনে লুকিয়ে ছিল এ ছবি, হয়তো বা আগের জন্মের দেখা ঠিক এইরকম কোনো
ছবি, কোনো মরচে রঙা রোদ্দুরে ঠিক এইরকম কোনো বিকেলে হয়তো পাহাড়ে চড়ার লুকিয়ে থাকা গল্প,
সেদিন কথা বলেছিলো ফিসফিসিয়ে! ছোটবেলায় সঞ্চয়িতা পড়ে শোনাতো মা। " দিনের আলো নিবে এলো,
সূয্যি ডুবে ডুবে, আকাশ ঘিরে মেঘ জমেছে, চাঁদের লোভে লোভে, মেঘের ওপর মেঘ করেছে, রঙের ওপর
রং ….রঙের ওপর রং? ' ঠিক এই জায়গাটায় আমি আটকে যেতাম, মনে মনে ঠিক শুরু হয়ে যেত ষোলো
এম এম এর সিনেমা, মেঘের ওপর যখন মেঘ জমে, সেটাকে না হয় সাদা কাগজের উপরে একটু কালো রং
ঘষে, তার ওপরে সাদা ঘষে ঘষে ফুটিয়ে তুলতে পারি কিন্তু কেমন করে রঙের ওপর রং ধরাবো?
তিনতলার ছাদে গিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম অনিমেষ। শহরের ভাঙাচোরা স্কাইলাইনে তখন
হলুদের ওপর সবুজের আভাস, তার ওপর সূর্যাস্তের কমলা আর বেশ খানিকটা ফিকে গোলাপীও। এই
এতো আলো, এতো রং আমার এই বাক্সের বারোটা রং দিয়ে কেমন করেই বা ফুটিয়ে তোলা সম্ভব?
আজ যখন পাহাড়ের আকাশ দেখছি, বদলে যাওয়া যাওয়া রং দেখছি তখন ঠিক সেই দুপুরটা ফিরে এলো।
মাস্টারমশাই এর মুখটা মনে এলো । মাস্টারমশাই এক দৃষ্টিতে নীলরংয়ের কাঁচের শিশির মধ্যে তুলি
ডুবিয়ে সাদা কাগজের পাতায় একটি ফোঁটা দিলেন। তাতে খানিকটা জল মিশিয়ে তিরতির করে ছড়িয়ে
দিলেন পাহাড়ের মাথায় মাথায়, তারপর ফিসফিস করে স্বগতোক্তির মতো বলতেন,"এটা হলো
টারকোয়াইস ব্লিউ !" বৈদুর্য মনির মতো সেই উজ্জ্বল নীল সেদিন থেকে মনের কোথাও একটা নতুন
নাম নিয়ে ফেলেছিলো! সেই রঙের নাম, ছুটি! আজ এই মুহূর্তে গাড়ির কাঁচে ছুটির ছায়া ফেলে ফেলে
আকাশের এই নীল রং আমায় পালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই কোন অতীতে!
বিকেলের আলো যখন বৃষ্টিভেজা নীল কুয়াশার গ্রাম মান্ডালার পাথুরে দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে চুইয়ে
পড়ছে তার সবটুকু নরম আভা নিয়ে, ঠিক তখনি দিরাং পৌঁছনোর কথা আমাদের ! কিন্তু হঠাৎই গাড়ির
ইঞ্জিন বিগড়োলো। সে একেবারে ধোয়াঁ টোয়া বেরিয়ে অস্থির। ড্রাইভার প্রমাদ গনলে, বলে গাড়ি ঠিক
করতে এখান থেকে ঘন্টা দুয়েক লাগবে, অথচ দিরাংয়ের রাস্তা এখনো প্রায় ঘন্টা দুয়েক। পাহাড়ি
বাঁকের মুখ, শুনশান সন্ধ্যের দিকে যাতায়াত খুবই কম। বেশ খানিকটা উদ্বেগের পর পাওয়া গেল
অরুণাচলের একদল পুলিশের লোক। অনুরোধ করতেই তারা ফোনে ডাকাডাকি করে গাড়ি আনালেন দিরাং
থেকে আরেকটি আর আমাদের গোটা গ্রূপটাকে সেই নতুন গাড়িতে করে পাঠানো হলো দিরাংয়ে। ওদিকে
নেমেছে অঝোরে বৃষ্টি। গাড়ির কাঁচ তুলেও সে বৃষ্টির হাত থেকে রেহাই নেই। রাস্তার ওপর হেডলাইটের
আলোয়, বেশ দেখতে পাচ্ছি ধোঁয়ার মত দলা পাকানো মেঘ ভেসে যাচ্ছে রাস্তার ওপর দিয়ে।..ঠিক যেমন
অতিবৃষ্টিতে আমরা এক হাঁটু জল ঠেঙিয়ে বিধান সরণি ধরে বাড়ি ফিরি কলকাতায়, তেমনি এখানে এক
হাঁটু মেঘ ঠেলে চলাচল।.. সে এক অপার্থিব দৃশ্য।. তার মধ্যে একটু পর পরেই চোখে পড়ছে, ঠিক গরু
নয় অথচ গরু আর ইয়াকের মাঝামাঝি কিছু জীব, গলায় তাদের ঘন্টা ঝোলানো, ঠুংঠাং শব্দে নীরবে
হেঁটে চলছে রাস্তার পাশ দিয়ে, কোন গন্তব্যে কে জানে। পরে ড্রাইভারের কাছ থেকে জেনেছিলাম,
ওগুলির নাম মিথুন। মূলত গবাদি পশু, কিন্তু জঙ্গলেই থাকে। ওর মালিকের গলার আওয়াজ শুনে নাকি
ওরা ঘন্টা বাজিয়ে ঘরে ফেরে।…দিরাংয়ে আমাদের থাকার ব্যবস্থা ছিল পাহাড়ি বাঁকের বেশ খানিকটা
ওপরে, ঠিকানা আও রিসোর্ট।হাড় কনকনে ঠান্ডা হাওয়া আর ঝুপঝুপ বৃষ্টিতে সেখানে ঢুকেই চটপট
রাত্রের খাবারের অর্ডার দিয়েই যে যার ঘরে সেঁধিয়ে গেলাম। ..ওদিকে বাইরে বৃষ্টি নেমেছে অঝোরে।
চটপট ফ্রেশ হয়ে আড্ডা বসলো দেবাশীষের ঘরে, সঙ্গে অনুপান গরম চা আর নিছক ভূতের গল্প।
এবার শুধু সামান্য লোডশেডিংয়ের অপেক্ষা। পাহাড়ে বৃষ্টি, লেমনগ্রাস এর হালকা গন্ধযুক্ত গরম চা
আর ভূতের গল্প! এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয় নাকি?
পরেরদিনের মেঘলা সকালটা আমার চোখে লেগে আছে, লেগে আছে আমার ক্যামেরার লেন্সও। এমন
কখনো হয়নি ! বেড়ানোর গল্প নিয়ে লিখতে গিয়ে কখনো এতো রং লাগেনি তো চোখে। এখানে এসে
ইস্তক যেন চোখের ওপর আলাদা করে রঙের এক আস্তরণ লেগেছে। সে রং ঠিক কোথায় লেগেছে
জানিনা। কখনো মনে হয়, সে লেগেছে চোখে, কখনো বা মনে করি ক্যামেরার লেন্সে আবার কখনো মনে
হয়, আসলেতে মন বলে যাকে বলি, সেখানটাতেই লাগলো বোধহয়। এ এক নিজস্ব নিখিল। একে লিখবো
বললেই লিখে ফেলা যায়না, আঁকবো বললেই তার রংই বা পাই কোথায়? পাহাড়ের সকাল আর পাঁচটা
ব্যস্ত শহুরে সকালের মতো না, এর একটা নিজস্ব আদর আছে, একটা আড়মোড়া ভাঙা আবদার আছে।
এখানে শেষ রাত্রির ঘুমঘোর লেগে থাকে চোখে যেন ভোরের স্বপ্নের পাতলা চাদরের মত। হোটেলের
ঘরের কাঁচের জানলার ওপর সাদা লেসের পর্দা ফাঁক দিয়ে তখনো সবটাই সাদা। কুন্ডলি পাকানো মেঘের
ফাঁকে ফাঁকে পাইনের চুড়ো। একবার আড়চোখে দেখতে না দেখতেই আবারো কুয়াশা জড়িয়ে আসে চোখের
মধ্যে। তবুও ভালো করে ঘুম ভাঙলো সুমিতের ডাকাডাকিতে।..ও ওই ওতো সকালেই সামনের পাইন
গাছটার ওপর একটা হিল ব্লু ফ্লাইক্যাচ্যার লেন্সবন্দি করে ফেলেছে। পাখি বিষয়ে বিদ্যে আমার
একেবারে নেই, কিন্তু পাখির ছবিতে আছে বৈকি। পাখিটা আকারে অনেকটাই একটু বড়সড় চড়ুইয়ের
মতো কিন্তু তার রং, সে দেখবার মত। পেটের দিকটায় উজ্জ্বল কমলাটে হলুদ আর ডানার ওপরটা
চকচকে ময়ূরকন্ঠী নীল। ওদিকে আমার পুত্র লাফালাফি করে একটা উজ্জ্বল হলুদ রঙের মথ ধরেছে,
সেই নিয়ে শিশুমহলে তখন বিস্তর জল্পনা কল্পনা। পাহাড়ে এই এতরকম পাখি, এতরকম নাম না জানা
ফুল আর কতরকম অচেনা পতঙ্গ আমাদের হঠাৎ করেই প্রকৃতির এতো বৈচিত্রের সামনে বিমূঢ় করে
তোলে। এই এতো ফুল, এতো রং, এতো পোকা এসব ভূভারতে ছিল ? শহরের মালিন্য কখন যে
মনগুলোকেও মলিন করে দিয়েছিলো, তাই তো জানতে পারিনি যে পৃথিবীটা শুধু মানুষের নয়, এদের
সক্কলের। সকলে মিলে জমিয়ে চা খাওয়ার পরে রিসোর্টের রাস্তা ধরে বেরিয়ে পরা গেল। পাহাড় কেটে
কেটে চমত্কার একটি রিসোর্ট এই আও রিসোর্ট। চড়ানোছিটোনো বাংলো টাইপের ঘর। প্রতিটি ঘরের
সামনে নাম না জানা ফুলের কেয়ারী, সাতরঙা অর্কিডের বাহার। একটু উঁচু ধাপে আছে একটি চমৎকার
ভিউপয়েন্ট। গোটা দিরাং গ্রাম নাকি শহর কি বলবো, তার সবটাই দেখা যায়। অনেক নিচ দিয়ে কুলকুল
করে শান্ত গার্গলের মতো স্বরে চমৎকার বয়ে চলছে কামেং নদী। কিন্তু কামেং নদী বললে ওর
অভিমানী মন ভরবে কেন ? কেননা ওর আরো একটা চমৎকার নাম আছে ! মনে পরে রবি ঠাকুরের সেই
কবিতা,…." আমাদের সেই গ্রামের নামটি খঞ্জনা, আমাদের সেই নদীর নামটি অঞ্জনা, আমার নাম
তো জানে গায়েঁর পাঁচজনে, আমাদের সেই তাহার নামটি ….." আমাদের সেই কামেং নদীর স্থানীয় নাম টি
কি জানেন? তার নাম …"জিয়া ভরলি" !
জিয়া ভরলি নামটা শুনলেই, কবেকার এক অন্তর্লীন মায়াময় বিরহী প্রণয়িনীর কথা মাথায় আসে। সে
যেন এই মেঘ কুয়াশার ফিসফিসানি অস্ফুট আবহমান গানে ভরা নদীর উপত্যকায় চিরটাকাল পিপুলের
গাছের পিছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে, কিন্তু তার জিয়া শেষ পর্যন্ত ভরেনি, কারণ সেই প্রেমিক
আসেনি কোনোদিনই। শুধু সেই অপেক্ষাটুকু জেগে আছে নদীর ওপরে থমকে থাকা হাওয়ায়।
………………..
সকলেই নেমে যায় নীচে বিখ্যাত পাকদণ্ডী রেলপথ বেয়ে
শীতের মেঘলা দিনে ছেড়ে দার্জিলিং
কোলাহল শান্ত, শুধু গোম্ফার ডং ডিং ঘন্টাধ্বনি বাজে
আর তুহিন বাতাসে ভাসে তুষার ও হিম, সুরেখা
আমি ও নিখিল শুধু রহে গেছি মুনলাইট গ্রোভে
স্টোভে শুধু কেটলির সোঁ সোঁ শব্দ নীলগিরি কফি
টেবিলে স্টিল লাইফ ওল্ড মঙ্ক রামের বোতল
ফায়ার প্লেসের কাঁপা কাঠের আগুনে কাঁপছে
হাইলাইট বোতল ও গ্লাস
সাপঘুম ইচ্ছে করে দীর্ঘবেলা ধরে, চলো তবে
পরস্পর তিনজনে ……….
জিয়া ভরলিকে ডানদিকে রেখে গাড়ি চলছে দিরাং থেকে মান্ডালার এবড়োখেবড়ো পথ ধরে। যতদূর চোখে
পড়ছে, সবুজে সবুজ। কালার প্যালেটে সবুজের যতরকম শেড কল্পনা করা যায়, এখানে প্রকৃতি তার
সবটাই যেন উজাড় করে দিয়েছে। শূন্য রাস্তার মোড়ে মোড়ে তখন নীলাভ মেঘেদের উন্মুখ জটলা, তারই
দু চারটে দিব্যি আমাদের গাড়ির জানলা ধরে ডানদিকে বাঁদিকে ঢুকে পড়ছে আবার কখন বেরিয়েও
যাচ্ছে। উদাস বাঁকের পথের দুপাশে সারি সারি আপেল গাছের সারি। সঙ্গীরা কেউ গুনগুন করে গান, কেউ
বা টাটকা কেনা সবুজ আপেলে মৃদুমন্দ কামড়, কেউ বা জানলায় মাথা রেখে হালকা ঘুম। বাচ্ছারা কেউ
গম্ভীর ভাবে টিনটিন এ ডুবে, কেউ বা উদাস চোখে ইতিউতি আর আমি বাইরে থেকে বছর চল্লিশ হলেও
ভিতরে ভিতরে সেই সাত বছরের অগাধ বিস্ময় নিয়ে জানলার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে দেখে নিচ্ছি চতুর্দিক,
নাক দিয়ে টেনে নিচ্ছি অনেকখানি গভীর শ্বাস, অক্সিজেন ! চোখ দিয়ে মনের গভীরে এঁকে নিচ্ছি এ
সমস্ত অলৌকিক দৃশ্যটা। মনে মনে খসখস করে লিখে নিচ্ছি গোটা অভিজ্ঞতাটা, এ নিজের সাথেই
নিজের এক আশ্চর্য খেলা। ছুটি মানেই নিছক ট্র্যাভেল নয়, হনহনিয়ে সমস্ত সাইটসিইং করে ফেলা
নয়, বরং গোটা জার্নিটাকে একটা তুলতুলে স্পঞ্জের মতো করে একটু একটু করে শুষে নেওয়া, তার
যাবতীয় অনুভূতিগ্রাহ্য অভিজ্ঞতাটুকু নিয়ে। সে আমার কাছে ছুটির বেলাকার এমন একটা খেলা,যে
খেলায় বেশ খানিকটা নিভৃতি প্রয়োজন, এই গোপন খেলাটি না থাকলে সে ছুটি ফাঁকা হয়ে পড়ে। ঠিক
যেমনটি লিখতেন রবিঠাকুর। "ছুটি নিতে চাই, কিন্তু ছুটির বেলাকার খেলা একটা কিছু না থাকলে যে ছুটি
ফাঁকা হয়ে পড়ে, সেই ফাঁকার ভার বইবে কে? " ফরফর করে প্রার্থনাপতাকা ছুঁয়ে আসা মেঘলা হাওয়া
সম্বিৎ ফেরালো। আকাশের চারপাশে তখন ফিকে গোলাপি আলো আর সে আলোয় শেষ বিকেলের
আলোয় অলস দিরাং গ্রামে আমরা তখন জং ফোর্টের সামনে।
জং আর্কিটেকচারের নাম আগে শুনিনি। মূলত ভুটান, তিব্বত, চীন বা বৌদ্ধধর্ম অনুপ্রাণিত এই
স্থাপত্যবিদ্যা বেশ অন্যরকমের। যেকোনো মনাস্ট্রি দেখলেই এর ধাঁচটি টের পাবেন। এই অবধি তথ্য
অবশ্য অনেকেরই জানা। কিন্তু যেটা জানতামনা, তা হলো, এই জং স্থাপত্য কিন্তু কোনোরকম
গড়পড়তা পরিকল্পনা ( মানে আগমার্কা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ভাষায় প্ল্যানিং ) ছাড়া শুধুমাত্র একজন
উচ্চপদস্থ লামার অধীনে তৈরী হয়, যেখানে আধ্যাত্মিক প্রেরনায় গাঁথা হয় এর প্রতিটি ইঁট, বা ধাপে
ধাপে তৈরী হয় এর মূল কাঠামো। মূলত পাথরের ওপর পাথর সাজিয়ে তৈরী খাড়া উঁচু অট্টালিকা। যাঁর
সটান দেওয়ালে জানলার সংখ্যা খুবই কম, দরজায় একটি মূল ফটক ছাড়া আর নেই বললেই চলে। মূল
দরজাটি বেশ ভারী কাঠের বা ধাতুর তৈরী এবং ছাদের ওপর পাথরের বা এসেবেস্টসের চাল। এখন যে
কেল্লার সামনে দাঁড়িয়ে আছি, এটাকে কেল্লা না বলে বরং পুজোর সময় দেশপ্রিয় পার্কের থিমপুজোর
মতন একটা চত্বর বলা যেতে পারে। যদিও ইতিহাস বলছে এ অঞ্চল প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো,
কিন্তু এক ঝলকে এ কেল্লার বয়েস বোঝা দুষ্কর। চতুর্দিকে দেওয়ালের ভিতর উজ্জ্বল হলুদ পর্দার
কুঁচির নিচে সরিষা এরই লাটাইয়ের মতো প্রেয়ার হুইল বা ধম্মচক্র, যার গায়ে পালিভাষায় লেখা, ওম
মণিপদ্মে হুম ! লম্বা পাথারে বাঁধানো চাতালের চারদিকে ছড়ানো ছিটোনো মনাস্ট্রি, লামাদের থাকার
জায়গা ও সাধারণ মানুষের ঘর গেরস্থালি। মাঝখানে বোধহয় শাসক বা জমিদারগোত্রীয় কোনো
মানুষের জন্য মাথায় বেশ উঁচু অফিসঘরের মতো মিনার। দেখলে মনের মধ্যে বেশ একটা সম্ভ্রম জাগে।
খুব ছোটবেলায় দেখা ব্রুসলির ছবিতে এরকম বেশ কয়েকটা বাড়ি দেখেছি মনে এলো। জং কেল্লার
সামনে পাথুরে দেওয়াল আর পাহাড়ের সবুজের দারুন সব টেক্সচার পেয়ে ওখানে হুটোপাটি করে ছবি
তোলার লোভ কেউই সামলাতে পারিনি!
এবার যাত্রা সবুজ থেকে বরফ মখমল পাহাড়ের দিকে, ভূমিকার মত দিরাং আর সামতি ভ্যালি পেরিয়ে
গাড়ি ঢুকবে মেন্ল্যান্ড অরুণাচল জ্ঞান হওয়ার পর থেকে বরফের পাহাড় বলতে শুধুমাত্র
সুইৎজারল্যান্ড বুঝতাম। রঙিন টিভিতে তখন একের পর এক যশ চোপড়ার সিনেমা দেখতাম। হয়
মাধুরী, নয় শ্রীদেবী, নয়তো আরও পরের দিকে কাজল প্রত্যেকে বরফচূড়ো পিছনে রেখে সবুজ ঘাসে
ঢাকা উপত্যকায় ফিনফিনে শিফন সমুদ্রনীল শাড়ি পরে কত লাস্যে নেচে চলেছেন, গান গেয়ে চলেছেন
আর প্রেম করছেন অবিশ্রান্ত। ওসব দেখে দেখে বরফের পাহাড় মানেই সেটা ওই আল্পসের পাহাড়
ছাড়া ভূভারতে কোত্থাও যেন নেই, বিশেষত, আমাদের দেশে তো যে নেইই নেই, তেমন একটা বোকা
বোকা ধারণা হয়েছিল। প্রথমবার যখন দার্জিলিঙে বরফ পড়তে দেখি আজ থেকে বছর পনেরো আগে,
আমি তো যাকে বলে প্রস্থরবৎ। তবে সেটা ছিল বেশ দূর থেকে দেখা। সে ভাগ্য আমার অরুণাচলে এসে
খুলবে, সে ভাবতেও পারিনি। মনে মনে কর্ণ কুন্তী সংবাদের কর্ণর মত বেশ একটা সমঝোতাই যেন
করে নিয়েছিলাম নিজের সাথে নিজেই, যে আমি রব নিষ্ফলের, হতাশের দলে ! দার্জিলিংয়ে তিন তিনবার
গিয়েও টাইগার হিলে সূর্য ওঠা দেখিনি, সিকিমে ডজনখানেক বার গিয়েও কাঞ্চনজংঘা আকাশপট জুড়ে
ঝকঝক করছে, সে দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তাই এ যাত্রাতেও বরফ পাবো, সেটা ধর্তব্যের
বাইরেই ছিল। ছেলেরা জিজ্ঞেস করলে, বলেছি, বরফ পাবি বাড়িতে, ডিপ ফ্রিজে! তবে ভাগ্যদেবী
সুপ্রসন্নই ছিলেন বোধহয় এযাত্রা। সেলা পাস্ পৌঁছনোর সাথে সাথেই দেখি সে একেবারে ঝুরঝুরা
বরফে ঢাকা পাহাড়চূড়ো। বাদামি পাথরের মাথায় মাথায় ধপধপে সাদা বরফের কিরীট। আর গোটা লেক
জুড়ে ঠিক যেন যশ চোপড়ার ছবির মতো কুন্ডলি পাকানো ধোঁয়া। বাচ্ছারা আনন্দে হুটোপাটি করে মুঠোয়
বরফ নিয়ে ছোড়াছুড়ি শুরু করলো, বাচ্চাদের মায়েরা, এই ধরিসনা, এই মুখে যেন না লাগে, ইত্যাদি,
প্রভৃতি করে শোরগোল শুরু করলে আর আমি নীল আকাশের নিচে নরম বরফে মোড়া উপত্যকায় হারিয়ে
যেতে যেতে মনে মনে বললাম, ইশ! শুটিং এর পাহাড়ের চেয়ে এ পাহাড়ের সৌন্দর্য্য যে আরো হাজারগুন
ভালো। আসলে ক্যামেরা যা দেখে তা মাপে বাঁধা, চোখ যা দেখে তার সাথে তার তুলনা হয় নাকি?
সেলা পাসের ছিটেফোঁটা বরফ পেয়েই আমাদের উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, কে জানতো সামনে অপেক্ষা
করছে একেবারে বরফিলা ওয়াদি! সে গল্পে আসবো পরে, তার আগেই গল্পে আসি, যশোবন্ত গড়
মেমোরিয়ালের! আমাদের ট্যুর প্ল্যানার যখন আইটিনারারি পাঠিয়েছিল, তখন যশোবন্ত গড় বলতে
ভেবেছিলাম কোনো কেল্লা টিল্লা হবে! কিন্তু আদতে যশোবন্ত গড় যে একটি বীর সৈনিকের
স্মৃতিবিজড়িত ওয়ার মেমোরিয়াল, সেটা বুঝতে পারিনি। আমাদের এই ট্যুরিস্টসুলভ চাপল্যে, আর
পাঁচটা সাইটসিয়িংয়ের জায়গার মতো বুড়িছোঁয়া দৌড়ে, এই জায়গাটা নেহাতই লিস্টেড কিন্তু এর
ইতিহাস জানলে গায়ে কাঁটা দেবে বৈকি! ৪ নং গাড়োয়াল রাইফেলসের একজন রাইফেলম্যান আর্মি
ছিলেন পাঞ্জাবের যশোবন্ত সিং রাওয়াত! ১৯৬২ ভারত চীন যুদ্ধে একা এক রাত্রে ২৫০ জনকে মেরে
তবে বীরের মৃত্যু বরণ করেছিলেন এই নির্ভিক সৈনিক। পরবর্তী কালে মরণোত্তর মহাবীরচক্র
প্রাপ্ত এই বীর জওয়ানের স্মৃতিরক্ষার্থেই অরুণাচল সরকার তৈরী করেন এই মেমোরিয়াল। ঠিক যে
গাছের নিচে ওঁর শেষ নিশ্বাস পড়েছিল, সেই গাছের ডাল অক্ষত রেখেই তাঁকে ঘিরে তৈরী হয়েছে সুরম্য
মেমোরিয়াল। এখানে ওঁর মূর্তি ছাড়াও, ওঁর বন্দুক বা নিত্য ব্যবহার্য জিনিসপত্র সযত্নে রাখা আছে।
লক্ষ্য করলাম, বাঙালি পর্যটকেরা এখানে এসে একটু অদ্ভুত মিশ্র অস্বস্তিতে পড়েন। যাঁরা একটু
বয়স্ক, চিরকাল পথের ধরে মন্দিরে ঘন্টা বাজিয়ে আরাধ্য দেবতাকে প্রণাম সেরে পরবর্তী যাত্রার
সূচনা করেন, তারা এখানে ভেবে পাননা, ঠিক কি করা উচিত। আর যারা অল্প বয়সী, তাদের কাছে তো
গোটা জগত্টাই নেহাতই পরে পাওয়া চোদ্দ আনা! তাই তারা সেলফি স্টিকে নিজেদের ছবি তুলতেই
ষোলোআনা ব্যস্ত। আর মাঝখানের কয়েকজন দো-আঁশলা মানুষ যেমন আমি, খুব বিমূঢ় হয়ে
ভাবছিলাম, যে দেশটাকেই আগাপাশতলা চিনিনা, সেই দেশের জন্য এই প্রচন্ড ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত চেপে
লড়াই চালিয়ে, অকাতরে রক্তপাত করে মৃত্যুটাকে মেনে নেওয়াটা ঠিক কতটা সহজ? ঠিক কোন শিক্ষা
থেকে সেবা কথাটার তাৎপর্য্য বুঝতে পারেন একজন জওয়ান? মজার কথা, দেশের র্প্রতি এই সেবার
নমুনা, কিন্তু আপনি আজও পাবেন এখানে। যশোবন্ত গড় মেমোরিয়ালের পথের পাশের ছোট্ট
ক্যান্টিনে আর্মির জওয়ানেরা আপনাকে বিনামূল্যে সারাবছর খাওয়াবে, গরম চা/ কিংবা কফি আর
মোমো কিংবা ইডলি জাতীয় খাবার। একের পর এক পর্যটকের গাড়ি এখানে দাঁড়ায় আর সকলকে
হাসিমুখে সারাদিন ধরে তুলে দেওয়া হয় হাতেগরম খাবারদাবার ও গরম জল! একটিবারের জন্যেও সে
ক্যান্টিনে বিশ্রাম নেই, বিরতি নেই!
অবশেষে তাওয়াং! যশোবন্ত গড় মেমোরিয়াল দর্শন করার সাথে সাথেই জানতাম, আমরা শেষমেশ
অফিসিয়ালি তাওয়াঙে। সমুদ্রতল থেকে প্রায় ১০০০০ ফিট উপরে পাহাড়ের উপর ফিটফাট এই শহর
কিন্তু বেশ ঝকঝকে। যদিও তাওয়াঙের প্রশাসন এখনো ভারতবর্ষের হাতেই ,তবুও চীন কিন্তু একে
দক্ষিণ তিব্বতের অংশ বলেই ধরে নেয়। সেই নিয়ে মিঠে খুনসুটির দিন আপাতত শেষ, ১৯১৪র শিমলা
চুক্তি অনুযায়ী ম্যাকমোহন লাইনের সীমান্ত বরাবর পরিস্থিতি ক্রমশই ঘোরালো হচ্ছে। যাইহোক,
আপাতত জোরদার আর ছপছপ বৃষ্টির মধ্যে কুয়াশা আর জলে সন্ধ্যের গাঢ় নীল অন্ধকারে আমরা
তাওয়াং ঢুকলাম। গোটা শহরটা যেন এক মস্ত বড় অজগরের কুন্ডলি পাকানো পিচ্ছিল চওড়া পিঠের
ওপরে উঁচু নিচু ঢালুপথে ছবির মতো সাজানো। প্রতিটি রাস্তার ঢাল সন্ধ্যের রহস্যময় অন্ধকারে তখন
অজস্র রহস্য নিয়ে উন্মুখ। ফিসফিসে বৃষ্টিতে রাস্তায় ছাতা মাথায় মানুষজন। আশেপাশে ঝকমকে
দোকানপাট, বাহারি জ্যাকেট থেকে রঙিন জুতো, প্রিন্টেড ড্রেস থেকে চেকটানা ছাতা নানারকম পশার
থরেথরে। নিয়ন জ্বলা দামি রিসোর্ট থেকে কমদামি হোটেল, ট্যুরিস্ট লজ আর ট্যুরিস্ট গাড়ির ভিড়ে
এই বৃষ্টির কনকনে সন্ধেতেও বেশ সরগরম তাওয়াং শহর। আপাতত লাগেজপত্র ঢুকিয়ে আমাদের
খাবারদাবার খোঁজার পালা। কি ভাগ্যিস, আমাদের গাড়ি এ শহরে ঢোকার সময়েই চোখে পড়েছিল
একচিলতে কাঠ্যের পাল্লার ছোট্ট রেস্তোরাঁর সামনে বড় বড় করে বাংলায় লেখা বোর্ড,
…"ষোলোআনা বাঙালিয়ানা"। বিশ্বাস করুন, বিদেশে ঘরোয়া খাবার এর খোঁজ পাওয়া, আর আলিবাবার
গুহার হিরে জহরতের সন্ধান পাওয়া একই ব্যাপার। তাই এই কদিনের মোমো আর নুডলসে অরুচি ধরা
মুখে, বাঙালি খাবারের সোয়াদ কতক্ষনে পাবো, সেকথা ভাবতে ভাবতেই দৌড় লাগলাম সেই
বাঙালিয়ানার সন্ধানে। নামেই তালপুকুর ,এদিকে ঘটি ডোবেনা। প্রথম দর্শনে তো আমাদের গড়িয়াহাট
এলাকার কোনো চা ঘুগনীর বেঞ্চি পাতা দোকানের মতোই ম্যাড়ম্যাড়ে অন্দর সে রেস্তোরাঁর। কিন্তু
রান্নাঘরে উঁকি দিতেই, আহা, এইতো সেই। অবিকল কলকাতার স্বাদের, ঘন ঘন মুসুরডাল, ঝিরিঝিরি
আলুভাজা, আলুপোস্ত, মাংসের লাল টলটলে ঝোলের খোসবাই ততক্ষনে আমাদের খিদে চাগাড় দিয়ে
দিয়েছে শতগুনে। এ হেঁশেলটি চালান আগরতলার এক বাঙালি দম্পতি। চমৎকার তাদের হাতের
কারুকাজ। সকালবেলায় সাদা লুচি কিংবা পরোটার সাথে আলুর তরকারি থেকে পুঁইশাক, কচি পাঁঠা
সবকিছুই হেঁশেলে মজুত তাদের। আগামী তিনদিনের তাওয়াং স্টেটা নেহাত মন্দ হবে বলে মনে হচ্ছে না
কিন্তু !
আমাদের হোমস্টের ঠিক উল্টোদিকে একটি মনাস্ট্রি। বাঙালি দাদাবৌদির হোটেলে রাত্রির
খাওয়াদাওয়া সেরে তুলনামূলকভাবে সকাল সকালই আমরা সকলে লেপের ওমের গভীরে। একদিকে
ঠান্ডার কামড় আর অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের দাপটে, নরম বিছানাই তখন শেষ আশ্রয়। রাত্রে
কতক্ষন ঘুমিয়ে ছিলাম জানিনা, মাঝরাত নাগাদ ঘুম ভাঙলো এক অদ্ভুত মন্ত্রধ্বনির শব্দে। আকাশে
তখন পূর্ণ চাঁদের মায়া। পাহাড়, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশার পাহাড়ি ঠিকানা তখন আদরের ঘুমে এপাশ থেকে
ওপাশ ফিরে শুচ্ছে। ভালুকপংয়ে ঢোকার সময়েই জানতে পেরেছিলাম গোটা অরুণাচল জুড়ে চলছে এক
বৌদ্ধ উৎসব। তাই এখানকার মনেস্ট্রিতেও রাত্রির অন্ধকার থাকতেই শুরু হয়েছে এই
স্তোত্রপাঠের সুরেলা কিন্তু রহস্যময় মন্দ্র এক শব্দ। ঘুমের মধ্যে শব্দের ধ্বনিটা মাথায় ঘুরপাক
খাচ্ছিলো, ওম মণিপদ্মে হুম কথাটাই যেন খুব চাপা অথচ স্পষ্ট করে বিভিন্ন সুরে বলা। আর ঘুম
এলোনা। দরজা ঠেলে ঘরের লাগোয়া বারান্দায় দাঁড়াতেই একরাশ শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া চিবুক ছুঁয়ে
গেল। এই এতো রাত্রেও চাঁদের আলো যেন জমজম করছে চারদিকে ! পাহাড়ের মাথায় মাথায় কুচি কুচি
সন্ধ্যাদীপ জ্বলছে যেন দীপাবলির জমজমাট রাত। সন্ধ্যের মেঘলা পাহাড়ে যাদের এতো অলৌকিক,
অনিশ্চিত আধো জ্বলা, আধো নিভে যাওয়া রহস্যের মতো দেখাচ্ছিল, মধ্যরাত্রির মালকোষে সেই
রূপশহর যেন অনিমিখ বাতিঘর। আকাশ প্রায় পরিষ্কার। ত্রয়োদশীর চাঁদের আলোয় ভাঙা ভাঙা
দুধগোলা জলের মতো অস্বচ্ছ কুয়াশার অথবা মেঘের এক একটা পাতলা স্তর ভেসে গেছে তিন পাহাড়ের
চুড়োর ওপর দিয়ে। সকাল হাওয়ার আর বোধহয় খুব বাকি নেই। পুব দিগন্তে তার আগমনবার্তার
নিশ্চিত আভাস। এমন বদলে যাওয়া চারপাশ, হঠাৎ করে এই হিরণ্ময় নীরবতা আমাদের আদ্যোপান্ত
কথায় মোড়া শহুরে মানুষদের কেমন অস্বস্তিতে ফেলে দেয়। মনে হয়, এমন নৈশব্দের রাতে খাতা খুলে
বসি। এমন নক্ষত্র খামারে একলা রাতে নেমে যাই, ঘুমন্ত শিশুর পাশ থেকে, ঘুমন্ত নারীর পাশ থেকে
সোনালী নৈঃশব্দে হেঁটে যাই ঢালুপথ ধরে কোনো এক অজানা অচেনা অরণ্যানী ধরে, তথাগতের মতো।
শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা কেন জানি মনে পড়লো হঠাৎ ! এই এমন রাতে কেন সে ডাকলো, সে
অনন্ত কুয়ার চাঁদ !
এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র-খামারে নবান্নের দিন
পৃথিবীর সমস্ত রঙিন
পদ্যগুলো নিয়ে যাবো, নিয়ে যাবো শেফালির চারা
গোলাবাড়ি থেকে কিছু দূরে রবে সূর্যমুখী পাড়া
এবার তোমাকে নিয়ে যাবো আমি নক্ষত্র খামারে নবান্নের দিন।
যদি কোনো পৃথিবীর কিশলয়ে বেসে থাকা ভালো,
যদি কোনো আন্তরিক পর্যটনে জানলার আলো
দেখে যেতে চেয়ে থাকো, তাহাদের ঘরের ভিতরে
আমাকে যাবার আগে বোলো তাও, নেবো সঙ্গে করে ।
ভুলে যেয়োনাকো তুমি আমাদের উঠানের কাছে
অনন্ত কুয়ার জলে চাঁদ পড়ে আছে!
না, পুব হিমালয়ের এ অঞ্চলে কোনো চূড়া দেখা দিলো না। অবগুন্ঠনে মোড়া রহস্যাবৃতার মতোই খানিক
তার আভাসে এলো, খানিক এলো কল্পনায়। তাকে দেখবো বলে রাতভোরের অপেক্ষাকে নেহাতই তুচ্ছ
করে সূর্যোদয় হলো, কিন্তু মেঘের পসরা সাজিয়ে। যা অধরা, তার রূপ স্বভাবতই বহুগুনে বাড়ে! সকাল
হতে না হতেই বেরিয়ে পড়লাম সকলে, তন্বী তাওয়াংকে হাতের তেলোর মতন করে দেখবো বলে।
হোটেলের ঠিক উল্টোদিকেই যে মনাস্ট্রি, তার পিছনে তখন শুরু হয়েছে রঙের খেলা।
সে রাত্তির প্রায় জেগেই কাটলো, পরেরদিন সময় মতোই সাতসকালে প্রাতঃরাশ সেরেই দুয়ারে
প্রস্তুত গাড়ি , সারাদিন গন্তব্য তাওয়াং শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চষে ফেলা ! সদ্য এক
পশলা বৃষ্টি হয়েছে তখন, মেঘলা আকাশ থেকে ঝিলিক দিচ্ছে অসমাপ্ত সকালের আলো, চারদিকে
সবুজের বিপুল সমারোহে টুপ্টাপ জল ঝরে পড়ছে পাইনের ডাল বেয়ে। বাস এসে দাঁড়ালো তাওয়াং
মনেস্ট্রির কাছের পার্কিং স্পটে। অনতিদূরের গুম্ফা থেকে ভেসে আসছে বিশেষ প্রার্থনাগান। গুম গুম
শব্দে আর ধুপের কড়া গন্ধে দুপুর হচ্ছে পাহাড়ে তখন। বিরাট প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়েই তখন
মনে পড়ছিলো কথাগুলো। তাওয়াংয়ে দাঁড়িয়ে যদি প্রথমেই একটি দেখার জায়গা খোঁজ করা হয়, তাহলে
লালচে ছোপ গালের স্থানীয় মানুষ থেকে পিঠে রুকস্যাক পোড় খাওয়া ট্যুরিস্ট পর্যন্ত সকলেই
আপনাকে প্রথমেই যে জায়গাটার নাম উল্লেখ করবেন, সেটি তাওয়াং মনাস্ট্রি ! তামাম বিশ্বের
দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং ভারতের সবচেয়ে বড় এই বৌদ্ধস্তূপ এক বিরাট বিস্ময়। তাওয়াঙ যাওয়ার
পরিকল্পনার স্টেজেই সকলের মুখে মুখে শুয়েছিলাম যে নামটা, সেটা এই মনাস্ট্রিরই। এমনিতেই
তিব্বতি ভাষায় এর নাম 'গোল্ডেন নামগে লৎসে' যার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, মধ্যরাত্রির
আকাশের ঐশ্বরিক স্বর্গীয় বিভা! শোনা গেলো ১৬৮০ সোনে পঞ্চম দলাই লামার উৎসাহে ও
প্রেরণায় এই মনাস্ট্রি তৈরিতে প্রধান উদ্যোগ নেন লামা লদ্রে গিয়াতস, মূলত মহায়ন বৌদ্ধধর্মের
পঠনপাঠন ও প্রচলনের জন্যেই এই মনেস্ট্রির নির্মাণ।
ধর্ম বলতে আলাদা করে কি কখনো বুঝিনি ! বাড়িতে লক্ষ্মীপুজো, দুর্গাপুজো, গাজন, সংক্রান্তি,
নিত্যপুজোয় যতটুকু যা দেখেছি তার অনেকটাই নিয়মনিষ্ঠা আর আচার বিচারের তোড়জোড়। তার সাথে
মিশে থাকতো অনেকটা খাওয়াদাওয়ার আর উৎসবের অনুষঙ্গও। ধর্ম বলতে প্রথা মেনে পুজোআচ্চার
বাইরে কি সেটা অনেকটা বড় হয়ে যা বুঝেছি, তা নিজের ভেতরের এমন একটা জায়গা অথবা জায়গার
অনুভবে পৌঁছনো যেখানে সুস্থিত হয়ে, শান্ত হয়ে, লগ্ন হয়ে একজায়গায় বসা যায়। এমন একজনের
সাথে সুখ দুঃখের দরবার করা যেখানে আমি আর আলাদা করে কোনো ব্যাক্তিমানুষ নয়, বরং শুধুমাত্র
এক দেহগত, মনগত অস্তিত্ব থেকে এক বিপুল অনস্তিত্বতে মিশে যাওয়া একটা প্রাণ। অন্নময়
কোষ থেকে জ্ঞানময় কোষে একটা শিফট ! হঠাৎ করে নিজের ব্যাক্তিপরিচয় ভুলে, বাকি পৃথিবীর
একটা ধুলোর মত অংশ হিসেবে নিজেকে অনুভব করার একটা অনুভব। মনেস্ট্রিতে অথবা চার্চে গেলে
আমার ঠিক সেই অনুভূতিটাই হয়। তাওয়াং মনেস্ট্রির সামনে দাঁড়িয়ে বিরাটের সামনে দাঁড়ানোর একটা
অনুভূতি হল । ঠিক যেমন সমুদ্রের সামনে দাঁড়ালে নিজের অস্তিত্ব বিন্দুর মতো ছোট হয়ে যায় অথবা
পাহাড়ের মত বিরাট নিসর্গের সামনে দাঁড়ালে ব্যক্তিগত অপ্রাপ্তি, অসূয়াগুলো ছোট হতে হতে মিলিয়ে
যায় এক সময়, সেইরকম! একটা অপূর্ব শান্তির অনুভূতি, একটা ভেতর থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া,
স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত।
মনেস্ট্রির সামনের রাস্তাটায় তখনো জমাট বাঁধা মেঘ, মেঘের মধ্যে দিয়েই সূর্যের ক্ষীণ আলোর
রেখা বরফচেরা হাওয়ার পাখায় ভর করে ভিজে পাইনের বনের ফাঁক দিয়ে তার প্রথম আঙ্গুল রেখেছে
তাওয়াং মনেস্ট্রির উজ্জ্বল ছবি আঁকা, প্রবেশদরজায়। সেখানে তখন রঙের খেলা, উজ্জ্বল কিন্তু
সৌম্য, শান্ত এক সুস্থিতি। লাল, নীল, হলুদ আর উজ্জ্বল সোনালী রঙে মন্ত্র থেকে তথাগত গৌতম
বুদ্ধের জীবনের নানারকম জ্ঞাত অজ্ঞাত জীবনের ছবি, প্রজ্ঞাপারমিতার ছবি, তারার ছবি আর
পাইনের গাছে গাছে জড়ানো সকালের হাওয়ায় তিরতির করে কাঁপতে থাকা প্রার্থনাপতাকা। এর ফাঁকে
ফাঁকেই ইশকুল চলছে। প্রায়অন্ধকার হলঘরে সারি সারি লাল কার্পেট বিছানো শ্রেণীবদ্ধ ঘরে
প্রত্যেকে সামনে ছোট ডেস্কের মতো এক একটি কাঠের টেবিল নিয়ে দুর্বোধ্য পুঁথিপত্র খুলে অদ্ভুত
একটানা সুরে পড়ছে। সে ভাষার মর্ম তো বুঝিনা, তবে সে পড়ার শব্দও যেন অনেকটা গানের সুরের
মতো। এর সুরে কি যে একটা রয়েছে, অনেকটা যেন অর্ফিউসের বাঁশির মতো, যার আকর্ষণ এক অমোঘ
মায়ায় জড়িয়ে ধরে ভিতরের মানুষটাকে। মন বলে, এর ভাষা বুঝিনা, কিন্তু অন্তর বলে এর নিহিত
অর্থটুকু বুঝি ! মনেস্ট্রির মূল প্রবেশ দ্বারের আগেই দুপাশে স্কুল, হলঘর, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম
ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে যাচ্ছি একে একে। মাঝেমধ্যেই কুন্ডলি পাকানো মেঘের ফাঁক দিয়েই কোনো একটি
ক্লাসের ঘন্টা পড়ছে আর সঙ্গে সঙ্গেই একঝাঁক লাল প্রজাপতির মতো ছোট ছোট লামাশিশুরা দৌড়ে
যাচ্ছে সম্ভবত ওদের পরবর্তী প্রার্থনার জন্যে অথবা হয়তো হোস্টেলের দিকে।
পায়ে পায়ে মনেস্ট্রির মূল বিশাল চত্বরে পৌঁছে গেছি ততক্ষন ! রঙিন কাঠের কারুকাজ করা মূল
ফটকের ওপর ভারী পর্দা ঝোলানো। পর্দা ঠেলে মনেস্ট্রির ভিতরে ঢুকলাম। ইংরিজিতে মেসমেরিজম
বলে একটি কথা আছে, বিরাটের সামনে ক্ষুদ্র দাঁড়ালে যেমন সেই বিশালত্বের বিরাট ব্যাপ্তিতে
তাৎক্ষণিকভাবে ভিতরে ভিতরে একটি সন্মোহন তৈরী হয়, যা সহজে কাটিয়ে ওঠা যায়না, ঠিক সেই
সন্মোহিত অবস্থা থেকে সম্বিতে ফিরতে সময় লেগেছিলো। ভিতরে সিলিং থেকে বিশালাকার রংবেরঙের
পতাকা আর ফুলের অন্দরসাজের মধ্যে প্রায় ৪০ ফুটের ও বেশি উঁচু গৌতম বুদ্ধের বিরাট এক সমাহিত
মূর্তি। উজ্জ্বল সোনারংয়ের মূর্তির ধ্যানস্থ চোখে অন্তরের ভেতর অবধি ছেনে নেওয়া এমন একটা
দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে কোনো শাসন নেই, কোনো অভিযোগ বা ক্রোধ নেই, শুধু আপনাকে বুঝে নেওয়া আছে,
মেনে নেওয়া আছে। এই ঈশ্বর বা ঈশ্বরের মতো যাকিছু তার সামনে ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, সন্তাপে,
শোকে, আনন্দে, ঊদ্দীপনে নতজানু হওয়া যায়. প্রণত হয়ে থাকা যায় ততক্ষন, যতক্ষণ না প্রাণের
সেই আনন্দময় কোষ থেকে বার্তা আসে…এক প্রবল দুঃখমোচন থেকে এক প্রগাঢ় আনন্দবোধটুকু
কেউ বলে দেয়না, সেই বোধটুকু ভেতর থেকে আসে। হাঁটু মুড়ে বসলাম দুমুহূর্ত। মাথা নত হয়ে এলো
আপনি। গৌতম বুদ্ধের দুপাশে এবং নিচে পদ্মসম্ভব এবং আরো অনেকজন শিষ্যের মূর্তি। সামনে
সুগন্ধি হাওয়ায় সারিসারি টেবিলে সিল্কের রঙিন তাংখার ওপরে রাখা তামা ও রুপোর অমূল্য কারুকার্য
করা কিছু দীপাধার, তাতে মোমের ওপর নিবাত, নিষ্কম্প স্থির শিক্ষা জ্বলন্ত। সে শিখা অনির্বান
শিখা। সকালের আলো আঁধারিতে তখন শুধুই অনাবিল শান্তির ইঙ্গিত।
ভাবতেই ভালো লাগছিলো আমরা যারা খুব সাধারণভাবে ধর্মীয় স্থানমাহাত্ম্য মানেই বুঝি, ভিড়ে
ভিড়াক্কার কর্দমাক্ত গলিতে হাজার হাজার মানুষের পিছনে লাইন দিয়ে পান্ডা ধরে অথবা ভি এই পি
লাইন খুঁজে পুজো দিই, এখানে সেসবের লেশমাত্র নেই। নেই কোনো প্রথাগত পুজোর উপকরণ, একশো
এক টাকা দিয়ে বোঝার ওপর শাকের আঁটি চাপিয়ে পুজো দেওয়ার কোনো ফিরিস্তি তৈরী করেননা
লামারা। এঁদের পুজো বড় নিরাসক্ত, বড় আন্তরিক, অধ্যাত্মিক। একটি কোনে রাখা মোমবাতি শুধু
জ্বালিয়ে দেওয়া নীরবে। আর চুপচাপ হাঁটু মুড়ে তাঁর সামনে বসে পড়া। ব্যাস। এরপর শুধুই ভেতরের দিকে
এক নীরব, নিঃসঙ্গ যাত্রা। চোখে পড়লো, বেশ কিছু ঘরভর্তি মানুষজনের মধ্যেও একেক জন দিব্যি
নিজের মতো করে একলা হতে পারলেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে, কোণের দিকে প্রায়ন্ধকারে বসে, তাঁরা নিজের
নিজের মতো করে ডুব দিয়েছেন তাঁদের ব্যক্তিগত ত্রাণের উদ্দেশ্যে। ছবি তোলার পালা শেষ করে,
আমিও একটু জায়গা খুঁজে নিলাম তথাগতের সামনে। আস্তে আস্তে চোখ ঝাপসা হয়ে বুজে এলো সমস্ত
আলো। সমস্ত শব্দ মিলিয়ে গেলো এক সম্মিলিত ওমকারে। হাওয়ায় ধূপের ভারী মিষ্টি কর্পূর গন্ধ
তখন আরো গাঢ় হয়ে উঠছে।
চোখ বুজলেও জ্যোতির এক অপর্ব চলাচল দিব্য টের পেলাম চোখের সামনে। ঠিক যেন আলোয়
আলোকময় হয়ে বন্ধ চোখের পাতার সামনেও কোনো এক অতীন্দ্রিয় দৈবশক্তির আবির্ভাব ! সে
জিনিস শুধু অভিজ্ঞতার, বর্ণনার নয়। আগেই শুনছিলাম, এ মনাস্ট্রি তৈরির ইতিহাসটুকু, সেটুকু মনে
পড়তেই গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠলো। কথিত আছে, মেরিক লামা ল্যদ্রে গিয়াতস, যিনি মূলত এই
মনেস্ট্রির প্রতিষ্ঠাতা, তাকে পঞ্চম দলাই লামা একদিন নির্দেশ দিলেন, তাওয়াং এর বুকে একটি
উপযুক্ত জায়গা খুঁজতে, যেখানে স্থাপন করা যায় এই মনাস্ট্রি বা বৌদ্ধ আশ্রম। তাঁর প্রিয় ঘোড়ায়
চেপে লামা অনেক বন পাহাড় ঘুরে ফেললেন , কিন্তু মনোমত জায়গা পেলেননা কিছুতে। নিরুপায়,
ক্লান্ত, অবসন্ন দেহে ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন পাহাড়ের গায়ে। ঘুম থেকে উঠে
দেখতে পেলেন, তার সাধের ঘোড়াটি আশেপাশে কোত্থাও নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তিনি দেখতে
পেলে পাহাড়ের মাথায় এক বিস্তীর্ণ তৃণভূমির মধ্যে মেঘ ছেঁড়া দৈব আলোয় নিশ্চিন্তে ঘাস খাচ্ছে তার
ঘোড়াটি। ব্যাস। ওই জায়গাটিই তার পছন্দ হয়ে গেলো এক মুহূর্তে। আজ সেখানেই এই তাওয়াং
মনেস্ট্রির জগৎজোড়া ব্যাপ্তি । এমনকি এই 'তাওয়াং' শব্দটির জন্ম ও এই উপকথা থেকে। তা
শব্দের অর্থ ঘোড়া, আর 'ওয়াং' শব্দের মানে, যাকে নির্বাচিত করা হয়েছে এমন। অর্থাৎ ঘোড়া যে
স্থানটিকে নির্বাচিত করেছে, সেটিই তাওয়াং ! ভাবতেও বিস্ময় লাগে, আজ সেখানে বিশ্বের দ্বিতীয়
বৃহত্তম বৌদ্ধ উপনিবেশ।
গোটা তাওয়াঙে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় গোটা পাঁচেক গুরুত্বপূর্ণ মনাস্ট্রি। পাঁচশোরই অধিক
সন্ন্যাসী থাকেন শুধুমাত্র তাওয়াঙে। এর মধ্যে আর পাঁচটা মনেস্ট্রির থেকে তাৎপর্যপূর্ণভাবে
আলাদা এনি গোমফা মনাস্ট্রি, যা আসলেতে নারীমঠ । অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে মহিলা শ্রমণাদের দ্বারা
পরিচালিত। তাওয়াং এর মূল শহর থেকে বেশ খানিকটা ওপরে , পাহাড়ের নির্জনতার মধ্যে। মজার কথা,
এখানে আপনি কেবল কার অর্থাৎ কিনা এ পাহাড় থেকে ও পাহাড়ের মাথায় টাঙানো রোপওয়ে ধরেও
দুলে দুলে যেতে পারেন, তবে সে দোলনমায়ায় মজবেন কিনা, সে আপনার মর্জিমাফিক। তাওয়াঙে গত
দুদিন ধরে যেরকম বিদ্যুৎ বেহাল অবস্থা দেখেছি, সে পথে আর পা বাড়ালাম না আমরা। তাই গাড়ি
করেই ঘন্টা খানেকের মাথায় পৌঁছনো গেলো আনি গোমফা'তে। খুব খুশিয়াল ও সপ্রতিভ দুজন শ্রমণা
আমাদের সবটাই ঘুরে ঘুরে দেখালেন। শুনেছিলাম, এরা খুব চমৎকার বাটার টি পরিবেশন করেন
অতিথিদের, অর্থাৎ নুন মাখন দেওয়া চিনি ও দুধ ছাড়া একপ্রকার লাল চা, যা লামাদের
নিত্যনৈমিত্তিক পানীয় ! কিন্তু যে সময় আমরা সেখানে ঢুকলাম, তখন বৃষ্টির পাল্লা বেড়েছে হাওয়ার
গতিতে পাল দিয়ে। তাই সেরকম ভাবে দেখার সুযোগ মিললনা। তবুও ওর মধ্যেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জানা
হলো, ওদের সাধনভজন পদ্ধতি। এখানকার যেকোনো মনেস্ট্রিতেই লক্ষ্য করেছি ময়দার মতো
মিশ্রণ দিয়ে বানানো একরকমের রঙবেরঙের আল্পনার মতো মণ্ড, মূল দেবতার সামনের সারিতে
সাজানো আছে পরপর। ঠিক অনেকটা আমাদের এখানে যেমন যেকোনো মঙ্গল অনুষ্ঠানে বাড়ির মেয়েরা
শ্রী বানান , সেরকম। ওরা জানালেন, ওটি আসলে ইয়াকের দুধের সোর্ জমিয়ে জমিয়ে বানানো একরকম
শক্ত বিস্কিটের মতো মিশ্রণ, ওতে রং দিয়ে, তারপর স্তরের পর স্তর সাজিয়ে ওঁরা তৈরী করেন
সহস্রদল পদ্মের মতো অপূর্ব সব কারুশিল্প। তার সাথে আশ্রমে তৈরী তীব্র গন্ধের মোটা মোটা ধুপ
আর তামার কারুকার্য করা কেটলির মধ্যে কর্পূর আর আরো কিছু পাহাড়ি পাতা মেশানো কষায়
স্বাদের একরকম জল। সে জিনিসের স্বাদ নেওয়ার সৌভাগ্য হলো আমাদের বেশ।
এসে পৌঁছেছি বুদ্ধ পার্কে। তাওয়াঙে পৌঁছনো ইস্তক যাঁকে গোটা শহরের উঁচু নিচু ঢালুপথের সর্বত্র
দেখতে পাওয়া যায়, সেই তথাগত বুদ্ধের বিরাট মূর্তি এই বুদ্ধ পার্কে। প্রায় শহরের মাঝখানে,
শাক্যমুনি বসে আছেন একটি টিলার ওপর , উচ্চতায় প্রায় ৬০ ফুট। তাঁর অর্ধনিমিলিতি শান্ত ধ্যানী
চোখ তাকিয়ে রয়েছে শহরের প্রতিটি কোণে, প্রতিটি মানুষের ভালো, মন্দর দিকে। বসন্তকালের
ঝকঝকে নীল আকাশ হোক কিংবা বর্ষার মেঘলা দুপুর, শীতের বরফে মোড়া উপত্যকা কিংবা গ্রীষ্মের
ধোঁয়াটে বিকেল, গৌতমের অনিমিখ দৃষ্টিভুমিতে সকলি যেন সমান। সারাদিনের মুহূর্তগুলো জমা করলাম
মনের খাতায় আর ক্যামেরার লেন্সে, পরেরদিনের জন্য প্রস্তুতির শুরু। ট্যুর অপারেটর এর কাছ থেকে
শুনলাম গন্তব্য মাধুরী লেক ! মাধুরী?
তখন কলেজে পড়ি ! বাড়ির কাছের সিনেমা হলে রিলিজ করেছে কয়লা ! অবশ্য বাংলায় কয়লা বললে
ব্যাপারটা ভারী অসংস্কৃত শোনায়, বলতে হবে হিন্দি স্টাইলে ঠোঁট বেঁকিয়ে কোয়েলা, তবে হবে! সে
ছবির শেষের সিকোয়েন্সটুকু পুরোটাই কিন্তু অরুণাচলে শ্যুটিং! ওতে 'তনহাই তনহাই ' বলে একটি গান
ছিল, মনে পড়ছে কারো ? সেই যে ডেনিম জিন্স হাতকাটা জামা আর গাঁদাফুল হলুদ রঙের একটি লম্বা
স্কার্ট পড়ে মাধুরী দীক্ষিত ঝর্ণার জলের নিচে স্নান করছেন আর নাচছেন, নাচছেন আর স্নান
করছেন! আর বোবা নায়ক শাহরুখ খান সেই ঝর্ণার ওপরে পাথরে বসে একটি রুপোর বাঁশি বাজাচ্ছেন।
ঝকঝকে নীল, সিরিলিয়ান ব্লু রঙের আকাশের আবহে , স্ফটিকের মতো ধপধপে সাদা সেই যে
গগনচুম্বী জলপ্রপাত, আমরা এখন তার সামনে। অবশ্য আমরা তো সিনেমাওয়ালা নই, তাই সামনে
যাওয়ার উপায় নেই। তাই বেশ খানিকটা দূরের ভিউপয়েন্ট থেকে দুচোখ মেলে বিমূঢ় বিস্ময়ে তাকিয়ে
আছি এই আশ্চর্য প্রপাতের দিকে। পোশাকি ভাষায় , নুরানাং ফলস। কথিত আছে, নূর নামের একটি
মঙপা উপজাতির ছোট্ট মেয়ে , যে কিনা ভারত চীন দ্বৈরথে সৈনিক যশোবন্ত সিংকে সাহায্য করেছিল,
তার নামেই নাকি নূরাননাং প্রপাত। আবার নূর শব্দের আরেক অর্থ অপার্থিব সৌন্দর্যের আলো, তা
সেখান থেকে এর নামকরণ হতে পারে। তা নামে কী বা আসে যায়, এমন সৌন্দর্য্যের কাছে হাঁটু মুড়ে
বসে পড়া ছাড়া আর কিছুই কি বলার থাকে ? প্রায় ১০০ মিটার উপর থেকে যেন স্বর্গের কাছাকাছি
মেঘের রাজ্য থেকে তাঁর সোচ্চার ঝরে পড়া। এই এতটা দূরে দাঁড়িয়েও তাঁর ঝড়ের মতো হাওয়া আর
বরফকুচির মতো জলের গুঁড়ো মেখে ভিজে যাচ্ছি আমরা। দুধসাদা জল ঝাঁপিয়ে পড়ছে পাথরের বুকে আর
কুলকুল স্রোতে ভেঙে খানখান হয়ে ভেসে যাচ্ছে স্রোতমুখ! রোদ্দুরের আলোয় রামধনুর বর্ণচ্ছটা!
বাজি রেখে বলা যায়, সারা ভারতবর্ষে যত জলপ্রপাত রয়েছে, অপার্থিব সৌন্দর্য্যে, এটি তার প্রথম
সারিতে। তখন মনে হয়েছিল, মাধুরী দীক্ষিতের সৌন্দর্যের কাছে এ সৌন্দর্য ম্লান! হায়, অল্প
বয়েসের সেই চোখ! এখন বুঝেছি, যে মাধুরী রয়েছে প্রকৃতির বুকে, তাকে যত নিঙড়ানো যায়. ততই তার
সুধা! সে সুধা দেখবার, বোঝবার মতো চোখটি শুধু অভিজ্ঞতা আর বয়সের উঁচুনিচু পেরিয়েই তৈরী হয়!
– কুশল ভট্টাচার্য্য –