আপনার ভাষা নির্বাচন করুন
দার্জিলিং,কার্শিয়াং, মিরিক, কালিম্পং- এই তালিকার সঙ্গে হালফিলে যে যে নামগুলো যুক্ত হয়েছে তা হল সিলারিগাঁও,তিনচুলে,তাকদা, চটকপুর। কিন্তু উত্তরবঙ্গের মায়া এত অল্পে, এত সহজে কাটিয়ে ওঠার নয়। প্রকৃতির রহস্য ভাণ্ডার এতোটাই বিপুল যে তার কূল-কিনারা খুঁজে পেতে বারে বারে সেই জালে নিজেকে জড়িয়েছে মানুষ।জেনেশুনে ধরা দিতে মন সায় দেয় বলেই গত বছরের জানুয়ারিতে হালকা শীতের আমেজ গায়ে মেখে পৌঁছে গেলাম কালিম্পংয়ের এক ছোট্ট গ্রামে। যার নাম কোলাখাম। অনেকেই শুনেছেন হয়তো, কিন্তু যাওয়া হয়ে ওঠেনি। মানুষের পদচারণা যে কম তার প্রমাণ পাওয়া যায় কোলাখাম এর নামমাত্র সংখ্যার হোমস্টে দেখে। গাড়ি চলাচলের রাস্তাতেও পাহাড়ি এবড়োখেবড়ো ভাব।তবে সকলের অলক্ষ্যে নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলছে এই ছোট্ট গ্রামটি। কালিম্পং জেলার লাভা তে অবস্থিত কোলাখাম এর নাম এসেছে ‘কোলা’ অর্থাৎ আখরোট গাছের থেকে। কারণ,একমাত্র এই পাহাড়েই নাকি আখরোট গাছ পাওয়া যায়। একটা সময় এখানে শুধুই লেপচাদের বসবাস ছিল। এই নাম তাদেরই দেওয়া। বর্তমানে অবশ্য অন্য বাসিন্দারাই বেশি থাকেন।
চার বন্ধুর ট্রিপ, সুতরাং উত্তেজনার পারদ তুঙ্গে।উত্তরবঙ্গের অচেনা কোণে উঁকি দেওয়ার আনন্দ সঙ্গে করে উঠে পড়লাম তিস্তা-তোর্সা এক্সপ্রেসে। গন্তব্য অবশ্যই নিউ জলপাইগুড়ি জংশন।সেখান থেকে গাড়ি বুক করে কালিম্পং এর রাস্তা ধরে এসে পৌঁছলাম কোলাখাম এ। কেমন জায়গা, কী সুযোগ সুবিধা আছে সবটাই অজানা ছিল। ঠিক হয়েছিল যে, থাকার জন্য দুদিনই স্থির করা হোক। প্ল্যান মত আগে থেকেই হোমস্টে বুক করা ছিল। ৮০০ থেকে ১০০০ এর মধ্যে এখানে ভালো হোমস্টে আপনি পেয়ে যাবেন। উত্তরবঙ্গের এই গ্রামগুলিতে প্রায় সবই কটেজ হোমস্টে। কাঠ দিয়ে বানানো, সুন্দর করে সাজানো দোতলা বাড়ি।ঘরের মধ্যেও কাঠের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উপরে উঠে বিকল্প শোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।
সকাল সকাল যখন কোলাখামে এসে নামলাম, মেঘ আর কুয়াশায় মিলেমিশে প্রকৃতির রঙ তখন ধূসর। এর সৌন্দর্য অন্যরকম। ধূসর এখানে ‘মলিন’ অর্থে প্রয়োগ হতে পারে না কোনোভাবেই। ঘরে ঢুকে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই চোখে পড়ল একটা কাঁচের জানালা। পর্দা সরাতেই ঝাপসা কাঁচের ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম পাহাড় চূড়া। তাকে আরো কাছে নিয়ে আসতে খুলে দিলাম জানালাটা। পাহাড়ের এই এক অদ্ভুত মোহ। দূর থেকে দেখে মন ভরে না। বারবারই মনে হয় আরো কাছে পেতে, তাকে ছুঁয়ে দেখতে।ক্যামেরাবন্দি করব বলে ফোনটা হাতে নিতেই দেখলাম নেটওয়ার্ক ধরেছে গ্যাংটক, সিকিম এর। এরপর খোঁজ নিয়ে জানলাম গ্যাংটকের পথ কোলাখাম থেকে বিশেষ দূরে নয়। সত্যি বলতে কি,সব জেনেশুনে ঘুরতে যাওয়ার চেয়ে পৌঁছে গিয়ে নতুন কিছু অনুসন্ধান করে জেনে ফেলা আমাকে অনেক বেশি আনন্দ দেয়।
প্রথম দিনটা কাটল হোমস্টে তে আরাম করেই।হোমস্টের মালিক কে আলাদা করে বলে আমাদের জন্য ডিম, মাংস ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হলো দুপুর ও রাতের জন্য। আর সন্ধ্যাবেলায় চা-পকোড়া। দিনপ্রতি খাবার খরচ ৫০০ টাকা থেকে শুরু হয়। যত ইচ্ছে ততবার চাওয়া যায়। পেট,মন দুইই ভরিয়ে খেলাম আমরা। পাওয়া গেল না শুধু মাছ। আরো কিছুদিন থাকলে হয়তো জোগাড় হয়েই যেত। তবে যাই হোক, কোলাখামের প্রকৃতির কাছে বাঙ্গালী হয়েও এই দুঃখ অনেক তুচ্ছ মনে হলো। এই জায়গা প্রকৃতির নিজস্ব জায়গা। ফুল,পাখি আর সবুজের সমারোহে প্রকৃতি তার রূপ পরিবর্তন করে দিনে রাতে। দ্বিতীয় দিন সকালবেলা আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়ি ধরে চলে গেলাম লাভা মনাস্ট্রিতে। বড়জোর আধ ঘণ্টার পথ। চারিদিক থেকে পাহাড়ঘেরা এই মনাস্ট্রি বৌদ্ধ ধর্মের এক স্থাপত্য। শান্তিপূর্ণ,মনোরম এবং স্বর্গীয়। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটানোর পর আমরা গেলাম ডেলো পার্কে, যা কিনা কালিম্পং এর ডেলো পাহাড়ে অবস্থিত। পাহাড়ি ফুলের যেন মেলা বসে গেছে সেখানে। মেঘ কেটে রোদ্দুর পড়তেই রংবেরঙের ফুলগুলো খিলখিলিয়ে উঠলো।এই উচ্চতা থেকে যে দিকেই তাকানো হোক কেবলই পাহাড়ের সুবিস্তৃত রূপ। এমন এক গভীরতার প্রতি গভীর টানেই তো মন তার তল হারিয়ে ফেলে। আমারও তখন সেরকমই অবস্থা।ডেলো পার্ক ঘুরে দেখে ফিরতি পথে আমরা খেলাম মোমো আর থুকপা। ‘থুকপা’ সম্পর্কে এখন আর বাঙ্গালীদের নতুন করে বর্ণনা দেওয়ার কিছু নেই। প্রায় সবাই সব জানে।
কোলাখামে দুদিন এভাবে পার করে দেওয়ার পর তৃতীয় দিনে সময় হয়ে এসেছিল পুরনো প্রেমিকের কাছে ফিরে যাওয়ার। হ্যাঁ, দার্জিলিং এর কথাই বলছি। গ্রামের শান্ত পরিবেশ ছেড়ে শহরের কোলাহলে মিশে যাওয়ার আগে সেটা আরো একদিন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হলাম ছাঙ্গে ফলসের আকর্ষণ এড়াতে না পেরে। লাভা থেকে এর দূরত্ব ১৪ কিলোমিটার, আর কোলাখাম থেকে ৫ কিলোমিটার। কোলাখাম এর তুলনায় এই অঞ্চলে জলপ্রপাতকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা রিসোর্ট এর সংখ্যা বেশি। তবে থাকার কোনো প্ল্যান ছিল না আমাদের। ছাঙ্গে ফলস কে একবার সাক্ষী করলাম মাত্র। দিন কয়েকের বিশ্রাম নেওয়ার জন্য,প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকার জন্য কোলাখাম সত্যিই আদর্শ জায়গা। তবে খুব কাছে এসেও আমাদের বাদ পড়ে গেল নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক। না,আমরা এখানে যাইনি তবে জানতে পারলাম যে, ১৯৮৬ তে তৈরি হওয়া ৮৮ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলের এই জাতীয় উদ্যানটি ইউনেস্কো স্বীকৃত একটি ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। রেড পান্ডা থেকে রডোড্রেনড্রন সবটাই এখানে নাগালের মধ্যে। এমনকি ক্যাম্প করে থেকে যাওয়াও যায়। কোলাখাম নামের গ্রামটি আসলে এই নেওড়া ভ্যালি তেই অবস্থিত। বুঝলাম,যেটুকু যা বাদ পড়ে গেছে তার স্বাদ নিতে আবারও ফিরতে হবে কালিম্পং-এ, আবারও ফিরবো কোলাখাম এ। এই পিছুটান টুকু রেখেই অবশেষে গাড়ি ঘুরলো দার্জিলিং এর দিকে।
কিভাবে যাবেন কোলাখাম
শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন গামী যেকোনো ট্রেন।
সেখান থেকে গাড়ি নিয়ে কোলাখাম পৌঁছতে সময় লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা।
– সৌমী ভট্টাচার্য্য –