আলেপ্পি থেকে কুল্লাম- এক স্বপ্নের ব্যাক ওয়াটার যাত্রা


Kerala

এতো নোঙরা জল কলকাতার খাল গুলোতেও দেখা যায় না,আর তার সঙ্গে কি বিশ্রী একটা গন্ধ । ক্রমশ কচুরিপানার দল চলেছে সারি বেধে । এতো কচুরিপানা বোধহয় সারা জীবনে দেখিনি ।এরা কোথা থেকে আসছে , কোথায় যাচ্ছে কেউ তার খবর রাখেনা । তবুও এই কচুরিপানার দলই যেন কেরালার ব্যাক ওয়াটারের প্রান ভোমরা । আমরা এখন আলেপ্পিতে । কেরালার ব্যাক ওয়াটারের মধ্যমনি , রোমান্টিকতার শেষ কথা , এক অনন্ত প্রকৃতি পাঠ,জেগে থাকা স্বপ্নের অসংখ্য গ্রামের,ঠিক ধার দিয়ে এক অলস যাত্রা । যেতে যেতে কখনও ইচ্ছে হয় , ওই যে ঘাটের পাড়ে যে বউটা বাসন মাজছে , ওকে ডেকে একটু গল্প করি , মাঝি ভাইইই –তোমার জালে আজ কি কি মাছ উঠল ? এইতো স্কুলের ঘন্টাটা খুব জোরে জোরে বেজে উঠলো , এরকম তো আমাদের স্কুলেও বাজত — সকালের স্কুল শেষ হয়ে গেছে বোধহয় ! হ্যাঁ ,, তাই-ই , ওইতো ছেলে-মেয়ে গুলো সব ছুটে আসছে জলের ধারে । হাত নাড়ছে আমাদের । চঞ্চল হয়ে গেলো মনটা । আমিও নাড়তে লাগলাম আমার হাত, ওদের দিকে তাকিয়ে –কি খুশি ওরা —-

সুপ্রিয় দার পরামর্শটা ভাগ্যিস শুনেছিলাম । আর তাইতো হাউসবোটের আকর্ষণীয় অলসতাকে মনের আড়াল করে আমরা উঠে বসলাম সরকারি লঞ্চে । আলেপ্পি থেকে কুল্লাম , মোট আট ঘন্টার যাত্রা পথ । কেউ বলে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জলপথ , কেউ বলে এক নিখাদ মায়া জড়ানো চরৈবেতি । সরকার বা সরকারি এই শব্দ গুলো বোধহয় শুধু দরকারই পুরন করে , বিলাসিতা নয় , এখানে ও তাই । লঞ্চের উপরের ডেকে খুব সাধারণ বসার ব্যবস্থা । লঞ্চ ভর্তি । স্থানীয় কিছু মানুষ , আর পর্যটকের দল । বেশিরভাগই বিদেশি , চলেছে দলবেঁধে । কেরালা তাঁদের খুব প্রিয় জায়গা ।

লঞ্চ এগিয়ে চলেছে । আলেপ্পি শহরের ভিতরের জল বেশ অপরিস্কার । আর চওরায় খুবই ছোটো। জলে ভেসে বেড়াচ্ছে অসংখ্য ছোটো ছোটো ক্যানপি , গন্ডোলা, হাউসবোট । সরু খাঁড়ি দিয়ে লঞ্চ এসে পড়ল ভেম্বানন্দ হ্রদে । সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে এর যোগাযোগ । তাই ভেম্বানন্দ হ্রদের জলে বেশ স্রোত । সারি সারি হাউসবোটের ব্যস্ততা । এ যেন এক দিবারাত্রির কাব্য রচনা হচ্ছে । মধুচন্দ্রিমা করতে আসা যুগল , লাজুক চোখে হাউসবোটের জানালা একটু ফাঁক করে আমাদের দেখল । ওই দূরের ওই বোট টায় ওরা মাছ কিনছে , জেলেদের কাছ থেকে । একটু দূরে চিত্কার চেঁচামেচির আওয়াজ । কৌতুহলী নজর । শব্দ গুলো বাঙলাই মনে হচ্ছে । মনে মনে বলি , এ বাঙালিই পারে । হঠাত্ দেখলাম ভদ্রলোকটি বেড়িয়ে হাউসবোটের বারান্দায় এসে বসলেন । চিত্কাররে স্তব্ধতা । দুটো পাখি কিছুক্ষণ আগে ওদের জানলার উপর থেকে উড়ে গেছিল , আবার এসে বসল । লঞ্চ এগিয়ে চলেছে । এ যেন সত্যি সত্যিই এক অলস মায়া । কিছুটা দূরে কয়েক হাজার পাতিহাস কে জলে ছেড়ে দিয়েছে কেউ । জাল দিয়ে ঘেরা জলের মধ্যে ওরা খেলা করছে । পানকৌড়ির দল এদিক সেদিক থেকে ডুব দিচ্ছে । কয়েকটা বালি হাস ডানা মেলে উড়ে গেল । সূর্য মাঝ আকাশে । লঞ্চ এসে থামলো দ্বিপ্রহরের আহারের সন্ধানে একটা ছবির মতো সুন্দর দ্বীপের ছোট্ট রিসর্টের সামনে । কেরালার আহারের স্বাদ নিলেন কেউ কেউ । আমরা ভাত সঙ্গে গব্যঘৃত কাচালঙ্কা সহযোগে । খাঁটি বাঙালি প্রমাণ দেওয়ার এ এক অদ্ভুত প্রয়াস । আবার যাত্রা শুরু । চোখে একটু ঘুম ঘুম , নি:ঝুম দুপুর । পাশের বাড়ির নারকেল গাছটা জলের উপরে এসে পড়েছে । ছোটো গাছে অসংখ্য নারকেল । ছোটো একটা ছেলে ঢিল ছুড়ল জলে ।ঝুপ ঝুপ আওয়াজ।একটা লোক ছিপ দিয়ে মাছ ধরছিল । বাড়ির বয়স্ক মহিলাটি ছোট্ট নৌক চালিয়ে কিছু বাজার করে নিয়ে ঘরে ফিরছে । আবার স্কুলের ঘন্টিতে ঢং ঢং , ঢং ঢং । স্কুলের ছুটি হলো বোধহয় ।
ছেলে মেয়ে গুলো দৌড় লাগালো বাড়ির দিকে । অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হলো । লঞ্চের উপরে যদিও শেড দেওয়া , পাশ থেকে জল এসে লাগছে গায়ে । আমরা তবুও সরে বসলাম না । চলন্ত ছায়াছবি যে আমাদের সঙ্গ নিয়েছে । একটু ফস্কালেই ফাঁকি । লঞ্চের গতি স্লথ হলো । সামনে একটা ব্রিজ । দুদিক থেকে উঠে গেল ওটা । মাঝখান থেকে রাজসিক চলনে এগিয়ে চলা । হঠাত্ নদী চওরা । লঞ্চের গাইড এসে বলে গেলেন এটা অষ্টমুড়ি লেক । আমরা চলছি একেবারে সমুদ্রের পাশ দিয়ে । মাঝে মাঝে বালুর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সমুদ্র । বাতাসে আঁশটে গন্ধ । বৃষ্টি বাড়ছে । ঢেউ বাড়ছে জলে । বিকেল তখন আকাশে । একটা ছোট্ট বিরতি । এ সৌন্দর্যের কোনো বর্ণনা হয় না । প্রায় জলে ভাসা একটা রেস্তারাঁ । কচুরিপানা গুলো ভেসেই চলেছে । রেস্তারাঁর বারান্দায় দাঁড়ালে মাথাটা কেমন জানি ঘুরছে । পরে বুঝলাম ওই চলমান কচুরিপানা গুলো রেস্তারাঁর বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের ইলিউশনে ফেলে দিয়েছে ।
আস্তে আস্তে অন্ধকার নামছে । অষ্টমুড়িতে আমরা তখন চলেছি সারি দিয়ে রাখা চাইনিজ ফিসিং-নেটের মধ্যে দিয়ে । আকাশে তখন লাল সূর্য । ডুব দিচ্ছে সমুদ্রের কোলে । এক স্বপ্নের যাত্রাপথ পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম কোল্লামে ।

– সুদীপ ভট্টাচার্য্য



শেয়ার করুন
Brush

আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ