মানাগ্রাম, ভারতবর্ষের উত্তরপ্রান্তের উত্তরাখন্ড রাজ্যে অবস্থিত ছোট্ট একটা গ্রাম। প্রকৃতঅর্থে যারা পাহাড় ভালবাসেন, তাদের জন্য স্থানটাকে অবশ্যই ‘স্বর্গরাজ্যের একটুকরো’ আখ্যান দেওয়া যেতেই পারে। বলা যায়, প্রকৃতিদেবী তাঁর সবটুকু উদারতা ঢেলে দিয়ে এই জায়গাটাকে নিজ হাতে তৈরী করেছেন।
মানাগ্রামে যেতে হলে, ভারতের যেকোন জায়গা থেকে ট্রেনে করে প্রথমে হরিদ্বার স্টেশনে, কিংবা প্লেনে করে জলি গ্রান্ট এয়ারপোর্টে গিয়ে, দু-জায়গা থেকেই জীপ, ক্যাব অথবা বাসে করে প্রথমে যেতে হবে বদ্রীনাথ। বদ্রীনাথ হলো উত্তরাখন্ডের ‘ছোটা চারধাম’, অর্থাৎ গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী-কেদারনাথ-বদ্রীনাথ এই চারটি তীর্থক্ষেত্রের একটি। বদ্রীনাথ মন্দিরে বিষ্ণু ভগবান পূজিত হন। চারিদিক সুউচ্চ পর্বতে ঘেরা, বরফের আচ্ছাদনে সজ্জিত বিস্তৃত গম্ভীর পার্বত্য পটভূমিতে অবস্থিত এই বদ্রীনাথ মন্দির। এইখানে বলে রাখা প্রয়োজন, যে বদ্রীনাথে যাবার উপযুক্ত সময় হলো এপ্রিল থেকে জুন, আর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর। বর্ষাকাল বদ্রীনাথ ভ্রমণের জন্য বিপজ্জনক। আর অতিরিক্ত বরফপাতের কারণে অক্টোবরের শেষের দিক থেকে মার্চের শেষ বা এপ্রিলের শুরুর দিক পর্যন্ত এই দীর্ঘ ছয়মাস বদ্রীনাথ মন্দির ও সংলগ্ন জনপদটিই সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। সেইসময় মন্দিরের যাবতীয় পূজাঅর্চনা বেশ অনেকটা নীচে অবস্থিত ‘জোশীমঠ’ বলে একটি জনপদে হয়ে থাকে।
এই বদ্রীনাথ থেকেই ভীষণ কাছে ঘুরে আসার একটা জায়গা হলো ‘মানাগ্রাম’। এইখানে আলাদা করে রাত কাটাবার সেরকম কোন বন্দোবস্ত নেই। বদ্রীনাথেই আছে ছড়ানো ছিটানো বেশ কয়েকটি জীপস্ট্যান্ড, তার যেকোন একটা থেকেই একটা জীপ নিয়ে, আর হাতে ঘন্টা চারেক সময় নিয়ে অবশ্যই ঘুরে আসার জায়গা এই ‘মানাগ্রাম’। উওরাখন্ড রাজ্য লাগোয়া ভারত-চীন সীমান্তের একদম শেষ জনবসতি হলো এই গ্রামটা। এখানের বিখ্যাত “হিন্দুস্তান কি অন্তিম দুকান” নামক চায়ের দোকানটি হলো প্রকৃত অর্থেই ভারতের শেষ চায়ের দোকান, তথা মানব অবস্থান। তারপরই আছে পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে দিয়ে চলে যাওয়া অদৃশ্য বর্ডার, তারপরই পরের দেশ চীন।
এই মানাগ্রামের বিশেষ আকর্ষন হলো গ্রামটির একদম শেষ প্রান্তে ওই চায়ের দোকানের আগেই একটি বিশেষ জায়গায় দুটি পাহাড়ের খাঁজ থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসা সরস্বতী নদী, এবং বেরিয়ে এসেই পাথরে আঁছড়ে পড়ে একটি তীব্র ঝরনার সৃষ্টি করে আর সাথে ওই ঝরনার জলের ছিটেতে সূর্যের রশ্মি এসে পড়ায় একটি চোখধাঁধানো রামধনুর স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি করেই আবার নিচের দিকে খানিক দূরেই পাহাড়ের কোলে নদীটির হঠাৎ কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাওয়া। এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এতটাই বিস্ময় সৃষ্টিকারী, যে গ্রামটা ঘুরে জীপে করে আবার বদ্রীনাথ ফিরে আসার পরও প্রত্যেকেরই ভ্রু তে কিঞ্চিৎ প্রশ্নবোধক ভাঁজ থেকেই যায়, যদিও উত্তর পাওয়া যায়না। এছাড়াও জায়গাটা কিছুতেই উপেক্ষা করতে না পারার কারণস্বরূপ আছে গ্রামটার জীবনযাপনের সরলতা, ওখানের সর্বসাকুল্যে হাতেগোনা কয়েকটা বাড়ির প্রত্যেকটার পাথরে সাজানো দাওয়ায় বসে সেই বাড়ির মহিলাদের হাতে বোনা ভেড়ার লোমের তৈরী শীতবস্ত্র বিক্রির আকুতি, যে ছয়মাস গ্রামটা বন্ধ থাকে সেই ছয়মাসের জন্য গ্রামের মানুষদের রসদ বাবদ খড়কুটো চাল ডাল জড়ো করার তৎপরতা, সূর্যের সবার প্রথম গ্রামটাকে ছুঁয়ে তারপর ওই হাড়কাঁপানো শীতেও সারাদিন গ্রামটাকে পরম স্নেহে আগলে রাখা, গ্রামটার মাঝখানে মাঝখানে অবস্থিত বদ্রীনাথের মা মূর্তিদেবীর মন্দির, ব্যাসদেবের গুহা, মার্কন্ডশিলা ইত্যাদি পৌরানিক দ্রষ্টব্য, সর্বপরি এই জনপদটাকে একপাশে রেখে কলকল করে বয়ে যাওয়া অলকানন্দা নদী, এবং আরো অনেক অনেক কিছু ….
বদ্রীনাথ গেলে, মানাগ্রাম অবশ্যই যাবেন। তা নাহলে, একটা ভীষণ ভালো প্রাপ্তি হাতের একদম সামনে এসেও অধরা থেকে যাবে। বদ্রীনাথ থেকে মানাগ্রাম যাবার জীপভাড়া মোটামুটি পাঁচশো টাকা। শেয়ার হয়না, নিয়ে গিয়ে ওখানে অপেক্ষা করে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার ওইটাই মোট ভাড়া। এছাড়া যাবার আগে প্রয়োজন হরিদ্বারে হোটেলে থাকার ব্যাবস্থা করে নেওয়া, এবং বদ্রীনাথেও হোটেলে থাকার বুকিং করে নেওয়া। যেদিন হরিদ্বারে পৌঁছবেন, সেই রাতটা হরিদ্বারে থেকে পরেরদিন বদ্রীনাথের উদ্দেশে বেরোনোই ভালো। কারণ হরিদ্বার থেকে বদ্রীনাথ যেতে এবং আসতে, দু ক্ষেত্রেই প্রায় বারো থেকে তেরো করে ঘন্টা সময় লাগে।