আপনার ভাষা নির্বাচন করুন
তাকে যে নামেই ডাকো না কেন ডানিউব , দানিয়ুব বা দুনাজ আসলে সে একটা নদী ই , ইউরোপে ভোলগা র পর দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী , যার উৎপত্তিস্থল জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট অঞ্চলের ব্রেগ , তারপর মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের দশটি দেশে র মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সেই উক্রাইনে এর কাছে ব্ল্যাক সি তে গিয়ে সাগরে মিশেছে , শুধু তাই নয় খোদার উপর খোদকারী ও আছে , মাঝে মাঝে ক্যানাল বা খাল কেটে নানান দেশের মধ্যে দিয়ে এর জল প্রবাহ নিয়ে যাওয়া হয়েছে , যেমন 1992 সালে ডানিউব থেকে একটি ক্যানাল নিয়ে যাওয়া হয়েছে নেদারল্যান্ডস এর সামুদ্রিক বন্দর রটারডাম অবধি , তার মানে এখন নর্থ সি বা আটলান্টিক থেকে ব্ল্যাক সি অবধি দীর্ঘ ৩৫০০ কিলোমিটার জলপথ এখন নৌ যাতায়াত এর জন্য উপযুক্ত, এবং শুধু কার্গো চলাচল ই নয় , নানান রকম রিভার ক্রুজে দু দিন থেকে দশ দিনের সফরে এখন নেদারল্যান্ডস থেকে সোজা জলপথে পৌঁছে যাওয়া যায় জার্মানি , অস্ট্রিয়ার লীনজ , ভিয়েনা , ব্রাটিসলাভা , প্রাগ হয়ে হাঙ্গারি র বুদাপেস্ট অবধি .
এতক্ষণ শিবের গীত টা গাইলাম তার উদেশ্য টা এবারে বলি , জলচর হবার সুবাদে সবই তো হোল আমাদের গঙ্গা , ব্রহ্মপুত্র থেকে সুদূর দক্ষিণ গোলার্ধের আমাজন , উত্তর আমেরিকার মিসিসিপি , কানাডার সেন্ট লরেন্স , মিশর এর নীল থেকে লন্ডন শহরের টেমস , রেনগুন এর ইরাবতী টু চীনের ইয়াং সি অবধি , তা বাকিটা রইলো কি ? অনেক ধরেই ইচ্ছে টা ছিল এই দানিউব এ জলপথে ভ্রমণের , এবারে সুযোগ টা করে নিলাম .
ব্রাটিসলাভা নাম টা এখন অনেকেই শুনেছেন , স্লোভাক এর রাজধানী , কয়েক বছর আগেও কেউ খুব একটা জানতেন না এই শহরের কথা , তবে এই দেশের মিনিস্ট্রি যেভাবে ট্যুরিজম এর প্রচারে নেবেছেন তাতে আগামী দু এক বছরে এখানে ও যে পর্যটকদের ঢল নামবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই . ব্রাটিসলাভা নিয়ে পরে আরো ব্যাপ্তি তে লিখছি এখন শোনাই দানিউবের গল্প .
ব্রাটিসলাভা এর কাছাকাছি অস্ট্রিয়ার রাজধানী শহর হোল ভিয়েনা , সারাদিন ই কিছুক্ষন অন্তর বাস , ট্রেন যোগাযোগ রয়েছে এই দুই যমজ শহরের মধ্যে , যখন ট্রাভেল প্লান করবেন তখন একটা দিন রাখবেন সকাল সকাল বাস বা ট্রেন এ গিয়ে বিকেলে দানিউবের জলপথে হাই স্পিড ফেরি বা ক্যাটামারণ এ ফেরা , বা উল্টো টাও করতে পারেন ,সময় লাগে প্রায় ৯০ মিনিট এর মত , সারাদিনে ৫ বার যাতায়াত করে এই ক্যাট , ভাড়া ৩০ ইউরো মাথাপিছু , যদিও এই ভাড়া বাস বা ট্রেন এর চেয়ে অনেকটাই বেশি তবুও দানিউবের জলপথে র সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে সহজে এই ছাড়া আর কোনো উপায় নেই .
এবারে আমাদের কথা বলি , আমরা ব্রাটিসলাভা এসেছিলাম বুদাপেস্ট থেকে ফ্লিক্স বাস এ , এবারে যাবো ভিয়েনা নদীপথে , টুইন সিটি লাইনার এর ক্যাট এর টিকিট আগে থেকেই বুক করা ছিল , টুইন সিটি লাইনার এর ক্যাট এর জেটি টি ঠিক শহরের উফো ( UFO ) ব্রিজ এর নিচে , আমাদের হোটেল থেকে নদীর ধার দিয়ে হাঁটা পথে ঠিক 5 মিনিট , খুব সুন্দর একটি হোম স্টে তে রাত কাটালাম , সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে লট বহর সমেত সাড়ে নটার মধ্যে জেটিতে এসে দেখি একেবারে জনশূন্য , ইনফরমেশন কাউন্টার এর মেয়েটি তো অবাক , আপনাদের ফেরি তো সাড়ে দশটায় এত আগে এসেছেন কেন বরং শহর ঘুরে এক কাপ কফি খেয়ে আসুন , আসল রহস্য টা পরে বোঝা গেল , আগের রাতে ঘড়ি একঘন্টা পিছিয়েছে , মানে সামার টাইম গত মধ্য রাতেই শেষ হয়েছে আজ থেকে আবার নরমাল বা উইন্টার টাইমের শুরু , তার মানে আমরা এসে গিয়েছি প্রায় দু ঘন্টা আগে , যাহোক নেট এর বুকিং প্রিন্ট আউট দেখিয়ে বোর্ডিং পাস নেওয়া হোল , এবারে শবরীর প্রতীক্ষা , নদীর পাশে সুন্দর রিভার ওয়াক , সার সার কাঠের লম্বা বসবার জায়গা , তারই একটিতে জায়গা করে নিলাম .
ক্রমে দু একটি করে লোক সমাগম হয়ে বেশ একটা ভিড়ের আকার ই নিলো , এবারে আমরা ক্যাট ছাড়বার নির্ধারিত পনটুন জেটিতে নাবলাম , শবরী এলো ঠিক সময়ে , বোর্ডিং হলো , আমাদের বোর্ডিং পাস এ সিট নম্বর ও ছিল , কাজেই কোনো হুড়োহুড়ি নেই , লাগেজ রাখবার জন্য পেছন একটা লকার এর ব্যবস্থা , এখন বেশ আরাম করে দারুন একটা রিলাক্সড মুড এ আমরা .
বাই বাই ব্রাটিসলাভা , বাই স্লোভাকিয়া , পিএ সিস্টেম জানানোর পর আমরা জেটি ছাড়লাম . দানিউব এর চওড়া এখানে প্রায় আমাদের দক্ষিণেশ্বর – বেলুড় এর মত , ভাবতে ভালো লাগছে সপ্তাহ দুয়েক আগে শুভ মহালয়া র দিনে আমরা কলকাতার মিলেনিয়াম জেটি থেকে বেলুড় অবধি ভিভাদা ক্রুইসে গঙ্গা বক্ষে একটি সান্ধ্য ভ্রমণে ছিলাম , ঠিক তার সপ্তাহ দুয়েক পর আমরা এখন এখানে পৃথিবীর অন্য এক প্রান্তে আরেক মহানদী দানিউবে ভাসছি .
জেটি ছেড়ে আমরা এখন পশ্চিম মুখী , প্রথমেই সেই বিখ্যাত উফো ( UFO ) ব্রীজের নীচে , যার একেবারে
চুড়োতে সেই ঘূর্ণিয়মান রেস্তোরাঁ তথা ভিউ পয়েন্ট , সময় কুলালে অবশ্যই একবার ঘুরে আসতে পারেন এখান থেকে , আমাদের সময় সংক্ষিপ্ত , তাই নীচে থেকে দেখে আশ মেটালাম . প্রসঙ্গত বলে রাখি যে দানিউবের অসংখ্য শাখা নদী বা ত্রিবুটারিজ রয়েছে ( প্রায় 60টির মতো ) , তারই একটি শাখা নদী হলো মোরাভা , সেই মোরাভা আর দানিউবের সঙ্গমে , কিছু দূরে নদীর বা পাশে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের মাথায় ব্রাটিসলাভার সেই বিখ্যাত ডেভিন ক্যাসল .
এবারে ছোট্ট করে একবার আমাদের এই নৌ যান টি বা পোশাকি ভাষায় ক্যাটামারণ তার একটু বর্ণনা দিয়ে নি , যারা আন্দামান বেড়াতে গেছেন তাদের অনেকেই পোর্ট ব্লেয়ার থেকে নীল বা হাভলক দ্বীপ অবধি মাকক্রুজ এর এইরকমই একটি ক্যাটামারণ এ ভ্রমণ করেছেন বা অনেক বছর আগে কোলকাতা র মিলেনিয়াম পার্ক জেটি থেকে হলদিয়া অবধি এইরকমই একটি জলযান যাতায়াত করতো , এইটি ঠিক সেইরকম ই একটি যান , এটির প্রপালসন পাওয়ার বা চালিকাশক্তি হলো দুটো ওয়াটার জেট যেটি সাহায্য করে ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার অবধি গতি বাড়াতে , দুটি ডেক , লোয়ার ডেক টি পুরোপুরি বসবার ব্যাবস্থা , আর আছে একটি বেভারেজ সেল্স কাউন্টার যেখানে বিভিন্ন রকমের ঠান্ডা পানীয় ও গরম পানীয় যেমন বীয়র ,কোক থেকে শুরু করে হট চকলেট , কফি অবধি পাওয়া যায় , আর তার পেছনে কিছুটা ওপেন ডেক যেটি প্রধানত ধূমপায়ীদের জন্য.
আর ওপরের ডেক টি যাকে বলে ক্যাপ্টেন স ডেক , সেটি মূলত নেভিগেশনের বা নৌ চালনার জন্য , তাছাড়া একটি লাউঞ্জে র ও ব্যাবস্থা আছে সেখানে .
সব মিলিয়ে প্রায় ১১৫ জন যাত্রীর বসবার ব্যাবস্থা আছে এই জলযানে .
এবারে ফিরে আসি সেই ডেভিন ক্যাসল এ , খুবই সুন্দর নদীর পারে র এই ঐতিহাসিক দুর্গ টি , ব্রাটিসলাভা থেকে ২৯ নম্বর বাস এ চড়ে আসা যায় এই ক্যাসল এ . যা হোক এগিয়ে চললাম নদী পথে , নানান ধরণের জলযান এই পথে , সেই রিভার ক্রুইসের বড় বড় বোট গুলো ও আছে যেগুলো ধীর শান্ত গতিতে এগিয়ে চলেছে অনেক লম্বা সফরে , সুন্দর সব সাজানো কেবিন সাথে নদীমুখি একটুকরো ব্যালকনি , যেন স্বপ্নের সফরে চলেছে যাত্রীরা , ইচ্ছে রইলো ভবিষ্যতে এইরকম নদীপথে একটি সফর করবার, ইউরোপে ভাইকিং হলিডেজ বলে একটি নামি ট্যুর কোম্পানি আছে যারা এই ধরণের ট্যুর গুলোর ব্যাবস্থা করে থাকে , তাছাড়া আভালন ওয়াটার ওয়েজ বলেও আরেকটি নামি কোম্পানি আছে যারা ইউরোপের অভ্যন্তরীণ জলপথে ভ্রমণের জন্য খ্যাত .
আমরা ছুটে চলেছি বেশ দ্রুত গতিতে , দু ধারের দৃশ্য অনেকটা আমাদের গ্রাম বাংলা বা যে কোনো নদীর সাথে বেশ মেলানো , মাঝে মাঝেই মাছের খোঁজে নদীর বাঁকে বাঁকে লিটল কর্মরেন্ট বা পানকৌড়ি র ভীড় , আজকে নদীর গতি পাহাড়ি নদীর মতো বেশ দ্রুত বা ফাস্ট ফ্লোইং হয়তো বা গত কয়েকদিনের ইউরোপের নানান জায়গায় বৃষ্টিপাতের জন্য , দেখতে দেখতে স্লোভাক এর সীমারেখা পার করে অস্ট্রিয়ার চৌহদ্দি তে ঢুকে পড়লাম , পাশের দৃশ্যাবলির কিছুটা পরিবর্তন , মাঝে মাঝেই ফিশারম্যান ভিলেজ , ছোট ছোট বাড়ি একটু উঁচু করে পাটাতন এর উপর , হয়তো নদীর টাইডাল এফেক্ট থেকে বাঁচবার জন্য , বাড়ির সাথে একটা ছোট মতো জেটি , তার সাথে মাছ ধরবার জন্য ছোট ছোট চাইনিজ ফিশিং নেট স্টাইলের ছোট ছোট নেট ঝোলানো , অপর পাশে হলুদ সর্ষের খেত , গ্রামের রাস্তায় গাড়ির আনাগোনা , স্বপ্নের পরিবেশ, আহা সামনের জন্মে যেন আমি এখানেই জন্মাই .
দেখতে দেখতে আমরা প্রধান দানিউব নদীপথ ছেড়ে দানিউব ক্যানাল এ প্রবেশ করলাম , বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে আমরা ভিয়েনা শহরে এ প্রবেশ করছি , কোলকাতায় ছেলের সাথে কথা বলে জেনে নেওয়া গেলো ভিয়েনাতে জেটিতে নেমে আমাদের হোটেলে যাবার জন্য কোন মেট্রো স্টেশন টি সব থেকে কাছে ,
নামলাম জেটিতে , লিফটে চড়ে লট বহর নিয়ে একেবারে মেইন রোড লেভেল এ , সামনেই দেখতে পাচ্ছি মেট্রো স্টেশন , এবারে ডিস্পেন্সার মেশিন থেকে টিকেট কেটে ও ভ্যালিডেট করে সোজা পাতালে U4 এর Schwedenplatz মেট্রো স্টেশনে .
কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য –
বুকিং ও অন্যান্য তথ্য
twincityliner.com
সার্ভিস টি চালু থাকে মার্চ মাসের প্রথম থেকে অক্টোবর মাসের শেষ অবধি .
একপিঠের ভাড়া 30 ইউরো জনপ্রতি .
– ক্যাপ্টেন দেবাশিষ দে –