আপনার ভাষা নির্বাচন করুন
শীতের শেষ দুপুর গুলো বড় মনখারাপের মরসুম,পাতা খসা শুরু,বারান্দা জুড়ে দক্ষিণা বাতাসের প্রবেশ,কানে কোকিলের কুহুতান এই সময় কি ঘরে বসে থাকা যায়।আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে। ফেব্রুয়ারি শেষ মার্চে শুরু থেকে পুরুলিয়া জুড়ে পলাশের আগুন লাগে। সবুজ পাহাড় লাল হয়ে ওঠে।আর হৃদয় জুড়ে বসন্তের রঙ লাগে।সে রং একে বারে আলাদা অন্য কিছু সাথে তার তুলনা চলেনা।
এই আবেগ সঙ্গী করে আমরা চারজন বন্ধু দোলের ছুটিতে পলাশের রাঙা আবির মেখে দোল খেলতে চললাম পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে। দোলের আগের রাতে হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে ঘুমাতে ঘুমাতে পরদিন সকালেই বড়াভূম স্টেশনে পৌছালাম ।গাড়িকে বলাই ছিল ।ষ্টেশন থেকে ৪৫ মিনিটের পথ অযোধ্যা পাহাড় ।তার নিচেই আরণ্যক লজে আমাদের বুকিং।পৌঁছে ফ্রেস হয়েই চা ও ব্রেকফাস্ট ।ততক্ষনে ” পলাশ পরব ” শুরুর মুখে। ঝুমুর ও সাঁওতালী গান, রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নাচ ।সকলেই গানের তালে কখোন মাথা কখোনও বা পা দোলাচ্ছেন আর চলছে একে অপরকে আবির মাখানো।কেঊ কাউকে চিনি না কিন্তু এই পরিবেশে আমরা সকলেই আপন।দুপুর পর্যন্ত দোল খেলে লাঞ্চ সেরে গাড়ি নিয়ে চললাম ছৌ নাঁচের মুখোশ তৈরি দেখতে।গ্রামের নাম চড়িদা।বাড়িতে বাড়িতে তৈরি হয় ছৌ মুখোশ ।যেমন তার রঙ তেমনই গর্জিয়াস।সাইজ অনুযায়ী তাঁর দাম।কিছু প্রিয় মানুষকে উপহার দেওয়ার জন্য নিয়ে নিলাম তিনজোড়া সাঁওতাল দম্পতির মুখ।এদিকে ঘড়ি তখন ঘোড়ার মত দৌড়চ্ছে ।এবারের গন্তব্য খয়রাবেড়া ড্যাম । যেতে যেতে রাস্তার দুধারে পলাশের লাল আগুন ক্রমাগত হাতছানি দিয়ে ডাকছে আর বলছে দুদন্ড দাঁড়িয়ে যাও এখানে কিন্তু দাঁড়াবার অবকাশ কোথায় ।এখনো যে খয়রাবেড়া বাকি আছে।
খয়রাবেড়া যখন পৌঁছুলাম তখন সুর্যের রঙ আর পলাশের রঙ মিলেমিশে একাকার।পড়ন্তবেলায় কে কতবেশী আগুন জ্বালাতে পারে তা নিয়ে যেন প্রতিযোগিতা চলছে।অবাক বিষ্ময়ে প্রকৃতির অপরুপ রুপের তারিফ করছি এমন সময়েই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামলো ।মনে হল আরও একটু আগে এলে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করা যেত রোদ জলের লুকোচুরি খেলা।কিন্তু কি আর করা ।এই পর্বে বাকি রয়ে গেল মুরগুমা আর দেউলঘাটা।লজে যখন ফিরলাম তখন সন্ধ্যে সাতটা। অযোধ্যা পাহাড়ে মাথার উপর দোল পূর্ণিমার গোটা চাঁদ।পাহাড়ের এপার থেকে ওপার রুপোলি রঙে যেন কেউ ঢেকে দিয়েছে। সামনের জলাশয়ে পুর্ণিমা চাঁদ সত্যি এক ঝলসানো রুটি।ইতিমধ্যেই লজে তখন শুরু হয়েছে সান্ধ্যকালীন আনন্দ অনুষ্ঠান ।ছৌ ,ঝুমুর, সাঁওতালী নাচ । শিল্পিদের সাথে অতিথিরাও পা মেলালেন ফাগুনেরও মোহনায় এর মাতাল সুরে।
বহু রাত পর্যন্ত চললো বসন্ত যাপন পরব ।সামনে পাহাড় আর পলাশের গাছ ।মহুয়া ফুলের গন্ধে চারিদিক ম ম করছে।কবির মতো বলতে ইচ্ছে করছিল “যেওনা রজনী আজি লয়ে তারাদলে”।খাওয়া শেষকরে জোছনা গায়ে মেখে একটু হাঁটলাম। তারপর ফিরে এসে বিছানায় শুতেই রাত কাবার ।
পরদিন সক্কাল বেলাতেই দেখি গাড়ি নিয়ে হাজির ড্রাইভার বিকাশ দা।আমরাও রেডি ।সোজা অযোধ্যা পাহাড় । পাহাড় অভিযানে প্রথমেই পাকদন্ডি বেয়ে উঠতে উঠতে লোয়ার ড্যাম দেখে নেওয়া এবং তারপর উপরে আপার ড্যাম ।মাঝে খানিকটা সময় বিশ্রামের ফাঁকে সেলফি টাইম ।সবুজ পাহাড়ে ঘেরা নীল জল।পাহাড়ের উপর কিছু গ্রাম আছে ।মাটির বাড়ি মহুয়া পলাশ গাছে ছাওয়া। সবুজ শালে ঢাকা পাহাড় বেয়ে এবার আমরা চললাম বামনী ফলস দেখতে ।বেশ খানিকটা যাওয়ার পর অবশেষে তাঁর দেখা পেলাম।পাথরে পাথরে ঠোক্কর খেতে খেতে তিনি নামছেন ।বুঝলাম এ হল বসন্তের বামনি।তাই যে রুদ্ররুপের গল্প শুনেছি তা এখন উধাও।মানসচক্ষে যেন দেখতে পেলাম বর্ষার বামনিকে।শত সহস্র ধারায় সে নেমে আসছে উপর থেকে নিচে।
স্থানীয় আদিবাসী যুবকদের শালপাতা ঘেরা দোকানে চা ডিমটোষ্টের খানিক বিরতি নিয়ে চললাম পরবর্তী গন্তব্যে। বহুবার নাম শুনেছি ।এমন কি পুরুলিয়া প্ল্যানিং এর সময় গুগলে দেখেও নিয়েছিলাম।এই পাহাড় প্রদেশের সেরা আকর্ষন ব্লু লেক।মার্বেল পাথরে ঘেরা এই ব্লু লেক। অযোধ্যা পাহাড়ের প্রধান আকর্ষন।অবশেষে পৌঁছলাম লেকের ধারে।সাদা মার্বেলে ঘেরা চারদিক ।মাঝে নীল জলের লেক ।এছবি তো বিদেশের নানান পোস্টারে দেখেছি কিন্তু এমন জায়গা যে বাড়ির কাছেই হাত বাড়ালে মিলবে তা তো জানতাম না।
বেশ খানিকটা সময় কাটিয়ে প্রানভরে ছবি তুলে শেষ দুপুরে লজে ফিরলাম। অসম্ভব ক্ষিদে পেয়েছে।খাবার টেবিলে বসতে না বসতেই পাতে পড়ল গরম গরম ভাত, কাতলা মাছ আর দেশী মুরগীর লালচে ঝোল ।উদর শান্তি তো জগত শান্তি ।প্রায় সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমোলাম।সন্ধ্যায় হাতে চায়ের কাপ আর গরম পকড়া নিয়ে বসলাম কুসুম গাছের নীচে।বন্ধু তখন গাইছে নিজের মত করে “এই রাত যদি না শেষ হয় তবে কেমন হত তুমি বলোতো”।আমি ফিসফিস করে কুসুমকে বললাম অনেক কিছুই বাকি রয়ে গেল।আবারো ঠিক আসবো । নতুন বছরে একবার শুধু ডাক দিয়ে বোলো বসন্ত এসে গেছে।
হাওড়া থেকে রোজ রাত ১১:৫ চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন ছাড়ে যা সকালে বড়াভূমে থামে।সেখান থেকে ছোট গাড়ি বা অটো বুক করে অযোধ্যা পাহাড়।এছাড়া কলকাতা ধর্ম তলা থেকে বাসে পুরুলিয়া এবং ওখান থেকে অযোধ্যা পাহাড় যাবার বাস যায়।
অযোধ্যা পাহাড় নেবে লজ নিতে হবে।ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে পাহাড়ে উঠতে হবে সেটা আলাদা চার্জ।
কোথায় থাকবেন-অযোধ্য মোরে অনেক লজ আছে।আছে যুব আবাসও ।আমরা ছিলাম আরণ্যকে ।