ঘরকুনোর প্রকৃতি প্রেম


রাত তখন দুটো।
দরজায় টোকা পড়লো।
এতো রাতে এই জঙ্গলে কে ডাকে! ছোটবেলায় নিশির ডাকের গল্প শুনে ভয় পেতাম। শুনেছি একডাকে নাকি সাড়া দিতে নেই! সেসব বিশ্বাসের দিন অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছি। তা বলে রাত দুটোর সময় গভীর জঙ্গলের একটা কাঠের কটেজে যদি কেউ দরজায় টোকা মারে, বুকটা ছ্যাত্ করে উঠবে না? ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলাম। কে? দরজার ওপার থেকে প্রায় ফিসফিস করে একটা কন্ঠস্বর কানে এলো, ” পিকলু তোরা দুজনে চুপচাপ উঠে আয়। জোরে কথা বলিস না।” এ কী পাল্লায় যে পড়েছি। জঙ্গলে এডভেঞ্চার আমার বই এ পড়তেই ভালো লাগে। বুদ্ধদেব গুহ আমি মাথায় করে রাখবো। কিন্তু রাত দুটোর সময় জঙ্গলে যেতে বললে এই ঘরকুনো’র হার্টবিট দ্বিগুণ হবেই হবে। তার উপর আবার যে সে জঙ্গল তো নয়, উড়িষ্যার সিমলিপাল।

সিমলিপালে’র গভীর অরণ্যে জারান্ডা’র জলপ্রপাতের পাশেই কাঠের একটা কটেজে উঠেছি আমরা। তিনটে ঘর। তিন বন্ধু সস্ত্রীক। এই ছয় জন বেরিয়ে পড়েছি জঙ্গল অভিযানে। ২০০৭ সালের মার্চ মাস। মিঠি’র জন্মের বছর দুই আগে। ছ’জনে মিলে বালেশ্বরে রাত কাটিয়ে যাবতীয় রেশন সংগ্রহ করে একটা গাড়িতে রওনা দিয়েছি জঙ্গলে। ছয়জনের দলে গাইড বলতে ড্রাইভার যুবকটি এবং অদৃশ্য উপস্থিতি বুদ্ধদেব গুহ’র। তাঁর লেখাতেই তো প্রথম সিমলিপাল পড়েছি। সেসব পড়তে তো ভালোই লেগেছে। কিন্তু যতই গভীর জঙ্গলের দিকে আমাদের গাড়ি এগোচ্ছে, বাঘ, হাতি,ব্ল্যাক প্যান্থারের জঙ্গল যেন মনে হচ্ছে গিলে খেতে আসছে। এই ঘরকুনো বাঙালির টিম লিডার এক ইউরোপীয় কলজের যুবক। আফ্রিকার জঙ্গল কিম্বা এভারেস্টের চূড়ায় জন্ম হতে হতে সৃষ্টি কর্তা তাঁকে ভুল করে গোবরডাঙা নামক এক জনপদে জন্ম দিয়ে ফেলেছেন। তিনিই আমাদের টিম লিডার। নাম, শঙখ শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অরফে আমাদের প্রিয় বিথিন,যাঁর কথা আমি বহুবার নানা ভাবে, নানান প্রসঙ্গে বলেছি। আবারও বলবো। অনেক বলেও শেষ করতে পারবো না। তবু বলবো। সেই বিথিনই রাত দুটোর সময় দরজায় নক্ করে বললো, ” চটপট তুই আর লেনা উঠে আয়। কোনো কথা বলবি না। আমি যেখানে যাবো ফলো করবি।”

রাতের সিমলি পাল জঙ্গলে বিচিত্র সব জন্তু জানোয়ারের অদ্ভুত কোরাস আর জলপ্রপাতের শব্দ। সেসব ভেদ করে নিজের ধুকপুকানির শব্দটা প্রথম আমার কানে এলো।দোল পূর্নিমার রাতের আকাশ যেন উজাড় করা চন্দ্রালোকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গভীর জঙ্গলকে। সেই আলোয় জারান্ডার জলপ্রপাত যেন রুপোলী অলংকারে জঙ্গল,পাহাড় কে সাজিয়ে দিয়েছে । আমরা বিমুগ্ধ হয়ে শুধু দেখে যাচ্ছি সেই রূপ। কী বিচিত্র সেই শোভা। আজও চোখ বন্ধ করলে পরিস্কার দেখতে পাই। সেই সঙ্গে জঙ্গলের পশুপাখির ডাক। এতো রকম ডাক একসঙ্গে কোনোদিন শুনিনি। কিছু কিছু শব্দ তো রীতিমতো শরীরে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছিলো। আর আমরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলাম। এর মধ্যে বুনো হাতির ডাক বেশ কয়েকবার কানে এসেছে। জঙ্গলে আমাদের পানীয় জলের উৎস এই জলপ্রপাতটি । এ জল বন্যজন্তুরাও পান করছে,আমরাও। একেই বোধহয় বলে বাঘে মানুষে একঘাটের জল খাওয়া। জারান্ডায় পৌঁছাতেই প্রায় সন্ধ্যে গড়িয়ে গিয়েছিলো। বিষধর সাপ কিম্বা বন্য জন্তু’র চেয়ে আমাদের বেশি ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো জঙ্গুলে মশা। এ মশা নাকি সাংঘাতিক। প্রত্যেকে আপাদমস্তক ওডোমস ক্রিম মেখে নিলাম। কেয়ারটেকার মশাইয়ের পরামর্শ মেনে। আমাদের কটেজের ত্রিসীমায় মানুষজন বিশেষ নেই। অনেক দূরে একটা সাঁওতাল গ্রাম আছে। সেই গ্রাম থেকে আসার সময় আমরা একটা মোরগ কিনে এনেছিলাম। সাঁওতাল গ্রামে একটা ছোট্ট দোকানও দেখেছিলাম। যেখানে চারমিনার সিগারেট পাওয়া যায়, এতো ছোটো এবং কড়া সিগারেট জীবনে দেখিনি। ফেলুদা কি এই চারমিনার খেতেন? ধারণা নেই। সেই সাঁওতালি গ্রাম থেকে আমাদের কটেজের দূরত্ব অনেকটাই। সন্ধ্যে গড়াতেই কেয়ারটেকার রান্না শুরু করে দিলেন। মোরগের মাংস আর হাতে তৈরি রুটি। এটাই আমাদের রাতের মেনু। কিন্তু খেতে গিয়ে এ কী বিপত্তিতে পড়লাম আমরা! মাংস যে দাঁতে কাটতেই পারছি না। যেমন শক্ত, তেমন ছিবড়ে! অগত্যা ভরসা ঝোল আর আলু। এদিকে জঙ্গলের রাতের মাদকতা বাড়তে শুরু করেছে। চাঁদের আলোয় ছ’জন মানুষ মনের আবেগ উজাড় করে দিচ্ছে। বিথিনের বউ শ্রাবণীর গানের গলা তুলনাহীন। ইন্দ্রাণী সেনের ছাত্রী সে। জঙ্গলের আবহে শ্রাবণী’র কন্ঠ যেন সেই রাতে অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিলো। রাত প্রায় সাড়ে বারোটা পর্যন্ত আমাদের আড্ডা চললো। জলপ্রপাতের একটানা শব্দটাও একটা সময় সয়ে এলো। চোখ বন্ধ করতেই সারাদিনের ক্লান্তির ছুটি। ঘুম আসতে তাই সময় নিলো না।

কাঁচা ঘুমটা ভাঙলো সেই রাত দুটো’র সময়ে। চাপা গলায় বিথিনের হুকুম, চটপট বেরিয়ে আয়। মার্চের রাতের জঙ্গল তখন কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। একটা উইন্ডচিটার গলিয়ে বিথিন কে অনুসরণ করছি। হাতে টর্চ আছে, কিন্তু জ্বালানো যাবে না। আমরা ছয় জনেই গুটিসুটি মেরে বসলাম একটা ঝোপের আড়ালে। একে কাঁচা ঘুম ভাঙার বিরক্তি, অন্যদিকে একটা অদ্ভুত ভয়, সব মিলিয়ে এই মধ্যরাতের এডভেঞ্চারের জন্য বিথিন কে মনে মনে বেদম গাল দিচ্ছি। সমস্যা হল, ওর উপর যতই রাগ হোক, মুখে কিছু বলতে গেলেই জিভ আড়ষ্ট হয়ে যায়। শব্দ খুঁজে পাওয়া যায় না। ওর মায়াবি মুখটা দেখে সব ভুলে যাই। আর এই সুযোগটাই ও নিয়ে যায়। সেবার ক্রিকেট ম্যাচে কী হল, আমরা দুজনে ব্যাট করছি। দিব্যি জমে গেছি। বিথিন একটা কভার ড্রাইভে একরান নিলো। আমি জানি ওটায় একরানের বেশি হয় না। ওর কী মনে হল, ও দুই নেবে। ওপ্রান্ত থেকে চিৎকার কিরছে, পিকলু ছোট্, আমিও বললাম নোওওওও ….কে শোনে কার কথা! ছুটতে শুরু করলো। আমি কি দাঁড়িয়ে থাকতে পারি? পড়িমরি করে ছুটলাম। ও ই রান আউট হয়ে গেলো। প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়েছিলাম সেদিন। তবু কিছু বলতে পারিনি। বিথিন আউট মানে ম্যাচ বিপক্ষের পকেটে। আমি, আমরা কী আর করতে পারি। বড়জোর চিৎকার করে ‘নোওওও’ বলতে পারি। সে কথা যদি সে ভ্রুক্ষেপ না করে, তো কী করতে পারি! চেয়ে চেয়ে শুধু দেখলাম,ও রান আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছে!

যাক সে কথা। আপাতত গুটিসুটি মেরে ঝোপের আড়ালে বসে আছি আমরা। হঠাৎ, বিথিন অস্ফুটে বলে উঠলো, ঐ দেখ্, সামনে তাকা। সামনে তাকিয়ে যা দেখলাম, মুহূর্তে বিথিনের উপর সব রাগ জল হয়ে গেল। ( ক্রমশ )

-সুদীপ বসু-

শেয়ার করুন
Brush

আপনার মতামতের জন্য ধন্যবাদ